3:34 pm , November 18, 2024
জুবায়ের হোসেন ॥ ১ নভেম্বর থেকে সারাদেশে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ ঘোষণা করা হলেও বদলায়নি চিত্র। সরবরাহ কমেনি পলিথিন ব্যাগের। বন্ধ হয়নি নিষিদ্ধ পণ্যটির পাইকারি দোকান ও কারখানা। নগরীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের অলিগলিতে ছোট কক্ষের মধ্যে মেশিন বসিয়ে উৎপাদিত হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ। ফলে নভেম্বরের ১৭ দিন পার হলেও এখনো মুদি দোকান, সবজি বাজারে ধরিয়ে দিচ্ছে পলিথিন। যারা দিচ্ছেন তরাও চান বন্ধ হোক পরিবেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ন এই পলিথিন। তবে এরজন্য আগে বাজারে বিকল্প ব্যবস্থা খুব জরুরী। তা নাহলে যতই অভিযান বা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক না কেন পলিথিনের ব্যবহার কমানো সম্ভব না।
সরকারের কঠোর নির্দেশনা বাস্তবায়নে অক্টোবরে নগরীতে সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান পরিচালিত হয়। নভেম্বরের শুরু থেকেই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে মাঠে নামে জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর। করা হয় জরিমানা, জব্দ সহ আটকও করা হয় অনেককে। কিন্তু তার পরেও প্রকাশ্যেই বাজারে ব্যবহার হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ।
বরিশাল নগরীর এমন কোন বাজার বা মুদি দোকান খুঁজে পাওয়া যায়নি যেখানে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে অন্য ধরনের ব্যগ ব্যাবহারের তাগিদ দিতে দেখা গেছে। এই অভিযানের গুরুত্ব ভোক্তা, বিক্রেতা, ক্রেতা সহ সকলে অনুধাবন করলেও এখন পলিথিনের বিকল্প নেই তাই বাধ্য হয়েই ব্যবহার করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা মনে করেন সরবরাহ বন্ধ করা গেলে বাধ্য হয়েই বিকল্প খুঁজে নিতেন ভোক্তারা। সচেতন মহল মনে করেন পরিবেশের শত্রু পলিথিনের উৎপাদন, পাইকারী বাজারজাতকরণের ওপর কঠোরতা আরেপ করলেই পলিথিন ব্যবহার বন্ধ সম্ভব। ‘মানুষ অভ্যাসের দাস’ তাই যদি বাজারে পলিথিন না থাকে তবে তারা এর বিকল্প খুঁজে নেবে।
২০০২ সালের ১ মার্চ পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের জন্য হুমকি পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালীন বিএনপি সরকার। তবে এ ক্ষেত্রে শতভাগ সফলতা দেখাতে পারেনি কোনো সরকারই। উল্টো গত ২২ বছরে বেড়েছে এর উৎপাদন ও ব্যবহার। গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেস্টা করা হয় পরিবেশবীদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান কে। একই সাথে তিনি পানিসম্পদ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শপথ গ্রহণের পর তিনি পলিথিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে ও ১ নভেম্বর থেকে সারা দেশে পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, বিপণন, পরিবহন, ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বরিশাল নগরীতে ৩ নভেম্বর থেকে পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে জেলা প্রসাশন ও পরিবেশ অধিদপ্তর। ওইদিন দুপুরে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন এর নেতৃত্বে নগরীর নতুন বাজারে অভিযান চালানো হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) লুসিকান্ত হাজং, সহকারী কমিশনার মোঃ শহীদ উল্লাহ, মোহাম্মদ লুৎফর রহমান, মো: রবিউল হাসান ভূঁইয়া, বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তর এর কর্মকর্তাবৃন্দসহ আরও অনেকে। অভিযানে বেশ কয়েকটি দোকান থেকে নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করা হলেও প্রাথমিকভাবে তাদেরকে জেল জরিমানা করা হয়নি। ব্যবসায়ীদের প্রাথমিকভাবে সতর্ক করা হয়। অন্যদিকে ১২ নভেম্বর দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে নগরীর পলাশপুর ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ৩ নম্বর গলিতে র্যাব-৮ ও বরিশাল পরিবেশ অধিদপ্তর যৌথ অভিযান চালিয়ে ২১ (২১৫০ কেজি) বস্তা অবৈধ পলিথিন জব্দ করে। এ সময় আটক করা হয় পলিথিন মজুদকারী আক্কাস হাওলাদার কে। পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল জেলা কার্যালয় সূত্র বলছে, ১৭ দিনে ৬ টি পৃথক অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। এতে কাউকে আটক করা না হলেও জব্দ হয়েছে ১০৫ কেজি ৭০০ গ্রাম পলিথিন। জরিমানা হয়েছে মাত্র ১০ হাজার টাকা। এসকল অভিযানে তারা কোন বাধার সম্মুখীন হননি। যাদের অভিযানের আওতায় আনা হচ্ছে তারাও মূলত পলিথিন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের পক্ষে। তবে বিকল্প না থাকায় তাদের করার কিছু নেই। পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাতকারীরা প্রকৃত দোষী। এদের বিরুদ্ধে কঠোরতার কোন বিকল্প নেই।
নগরীতে সরেজমিন দেখা গেছে, সুপারশপগুলোতে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হলেও বাজারের চিত্র আগের মতোই রয়েছে। বিভিন্ন সুপারশপে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে দেওয়া হচ্ছে কাগজের ঠোঙা। পণ্য বেশি হয়ে গেলে রয়েছে চটের ব্যাগ ও কাপড়ের ব্যাগ, যা ২৫-৩০ টাকায় কিনে নিতে হচ্ছে। কিছু গ্রাহক ব্যাগ কিনতে নারাজ হলেও অধিকাংশরাই বিষয়টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। অনেকে গাড়িতে ও বাইকে কাপড়ের ব্যাগ রাখছেন। তবে বাজারগুলোতে পলিথিনের ব্যবহারে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। পলিথিন ব্যাগ কোথায় পাওয়া যাবে এমন প্রশ্নে নগরীর চৌমাথা বাজারের এক সবজি বিক্রেতা বলেন, বাই সাইকেলে একের অধিক ব্যক্তি আসে বিভিন্ন মাপের পলিথিন বিক্রি করতে। এছাড়া বেশি প্রয়োজন হলে বাজাররোড থেকে পাইকারী দরে পলিথিন কিনে আনেন। এখনও দপদপিয়া, নলছিটি সহ নগরীর বাজাররোডে গোপন গোডাউনে মজুদ করে পলিথিন বিক্রি করা হয় বলে জানান তিনি। খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, বেশিরভাগ পলিথিন আসে ঢাকার চকবাজার এলাকা থেকে। নগরী সহ আশপাশের অসাধু ব্যবসায়ীরা এই পলিথিন চড়া লাভে বাজারজাত করে থাকে। ফোনে অর্ডার করলে চকবাজার থেকে পিকআপ ভরে পলিথিন পাঠিয়ে দেয়। যা রাতের আধারে মজুদ হয় নগরী সহ আশপাশের এলাকার গোপন গোডাউনে।
নাজমা আক্তার নামে এক ক্রেতা বলেন, শুকনো বাজার কাপড়ের ব্যাগে নেওয়া যায়। পলিথিন ছাড়া মাছ কীভাবে নেব? বিকল্প হিসেবে বহুবার ব্যবহারযোগ্য মোটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করার পরামর্শ দেন তিনি।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল জেলার সহকারী পরিচালক কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, অক্টোবর মাসে আমরা সকলকে সচেতন করতে প্রচারাভিযান চালিয়েছি। নভেম্বরের ৩ তারিখ থেকে পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা শুরু হয়েছে। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান অব্যাহত থাকবে। নির্দিষ্ট তথ্য পেলে এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উল্লেখ্য, পরিবেশ আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়, ‘যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন করে তাহলে ১০ বছরের কারাদ- বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দ-ও হতে পারে। পলিথিন বাজারজাত করা হলে ছয় মাসের জেল ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা’। কিন্তু বাস্তবে আইনের সর্বোচ্চ ব্যবহারের নজির এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।