বিভীষিকার সাক্ষী ভয়াল সিডর আজও উপকূলবাসীদের তাড়া করছে বিভীষিকার সাক্ষী ভয়াল সিডর আজও উপকূলবাসীদের তাড়া করছে - ajkerparibartan.com
বিভীষিকার সাক্ষী ভয়াল সিডর আজও উপকূলবাসীদের তাড়া করছে

4:05 pm , November 14, 2024

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ ইতিহাসের ভয়াবহ ধ্বংসলীলা সিডর এর কালোরাত্রী আজ। মৃত্যু আর ধ্বংস নিয়ে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যার জোয়ারে ভর করে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় পৌনে ৩শ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ ধেয়ে এসে দেশের উপকূলভাগের ১০টি জেলাকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। তবে প্রাক-প্রস্তুতি সহ আগাম সতর্কতার কারণে ইতিহাসের ভয়াবহতম ঘূর্ণিঘড়ে প্রানহানীর সংখ্যা যথেষ্ট হ্রাস পেলেও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। সরকারি হিসেবে সিডর-এর ছোবলে মৃতের সংখ্যা ৩ সহ¯্রাধীক বলা হলেও আরো প্রায় দু’হাজার  নিখোঁজ ছিলো। পরবর্তিতে তাদের প্রায় কারোরই সন্ধান মেলেনি। সেই কালরাত্রীতে প্রায় ২৫-৩০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাসে নিখোঁজদের প্রায় সবার  ঠাঁই হয়েছিল না ফেরার দেশে।
১১ নভম্বর দুপুর ১২টায় দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ২শ কিলোমিটার দক্ষিণে একটি লঘুচাপ সনাক্তের পরে তা ক্রমশ উত্তরÑপশ্চিমে অগ্রসর হয়ে আন্দামান নিকোবরের পূর্ব দিক দিয়ে উত্তর, উত্তর-পশ্চিম দিকে এগুতে থাকে। ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় লঘুচাপটি আন্দামান থেকে প্রায় ৫শ কিলোমিটার পূর্ব দিক দিয়ে সোজা উত্তরে এগুচ্ছিল। ক্রমে লঘুচাপটি নিম্নচাপ থেকে প্রবল ঘূর্ণিঝড় সিডরে রুপ নিয়ে ক্রমশ উত্তর দিকে বাংলাদেশÑভারত সীমান্ত উপকূল বরাবর অগ্রসর হতে শুরু করে। ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশ উপকূলের ৫শ কিলোমিটার দক্ষিণ দিয়ে ক্রমশ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মাঝ বরাবর রায়মঙ্গলÑহাড়িয়াভাঙ্গা উপকূল সোজা অগ্রসর হবার বিষয়াটি নিশ্চিত করে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
১৫নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের একশ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসে। ঝড়টি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় সুন্দরবন এলাকা অতিক্রম করবে বলে মনে করা হলেও আকষ্মিকভাবে তার গতিপথ উত্তরমুখি থেকে উত্তরÑপূর্বমুখি হতে শুরু করে।
সন্ধ্যা ৬টায় সিডর বঙ্গোপসাগরের জোয়ারে ভর করে আরো দ্রুত গতিতে উত্তরÑপূর্বমুখি হয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত থেকে প্রায় ৩শ কিলোমিটার পূর্বে বরগুনা এবং বাগেরহাটের মধ্যবর্তি হরিণঘাটা-বুড়িশ্বর ও বিষখালী নদীর বঙ্গোপসাগর মোহনা অতিক্রম করে পৌনে ৩শ কিলোমিটার বেগে মূল ভূ-খন্ডে আছড়ে পড়ে। সিডরের ব্যাপ্তি মাত্র দেড়শ কিলোমিটারে সীমাবদ্ধ থাকলেও তার দৈর্ঘ্য ছিল অনেক দীর্ঘ।
সাগরপাড়ের হরিণঘাটাÑপাথরঘাটা থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার উত্তরে বরিশাল মহানগরী পর্যন্ত একই সাথে প্রায় সমান তীব্রতায় সিডর নারকীয় তান্ডব চালায়। বরিশাল মহানগরীতেও সিডরের তীব্রতা ছিল ২২৪ কিলোমিটার। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত পশ্চিমে বাগেরহটের মোড়েলগঞ্জ, শরনখোলা, রামপাল থেকে বরিশাল হয়ে মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও গোপালগঞ্জ পর্যন্ত সিডরের বিভীষিকা অব্যাহত ছিল। সেরাতে পৌনে ৩শ কিলোমিটার বেগের ঝড়ের সাথে ২৫-৩০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাস উপকূলের বিশাল জনপদ সহ ফসলী জমি লন্ডভন্ড করে দেয়।
ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় দেশের দক্ষিণ উপকূলের ৩০টি জেলায় কম-বেশী আঘাত হানলেও ৭টি জেলার ২শ উপজেলার প্রায় সাড়ে ১৭শ ইউনিয়ন ভযাবহ ক্ষতির শিকার হয়। সরকারি হিসেবে ক্ষতিগস্ত পরিবারের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৩ হাজার বলা হলেও বাস্তবে তা ছিল ২০ লাখেরও বেশী। আর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭৫ লাখ। সরকারিভাবে ৩ হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু ও ১ হাজার ৭২৬ জন নিখোঁজের কথা বলা হলেও তা ছিল আরো অনেক বেশী।
সিডরের তান্ডবে দক্ষিণ উপকূলের বিশাল জনপদের প্রায় ৪ লাখ ঘরবাড়ী সম্পূর্ণ এবং আরো প্রায় ১০ লাখ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। একই সাথে প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির আমন ফসল সম্পূর্ণ ও আরো ৫ লাখ হেক্টর আংশিক ক্ষতির ফলে অন্তত ৫ লাখ টন ফসল বিনষ্ট হয়।  সিডরের সে কালো রাতে  প্রায় ৫০ লাখ গবাদী পশু ও হাঁস-মুরগীর মৃত্যু ঘটে । কোটি কোটি মাছের পোনা পুকুর ও ঘের থেকে বের হয়ে যায়।
তবে পরিবেশবীদদের মতে, প্রকৃতির ওই তান্ডব সেদিন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রুখে দিয়েছিল প্রকৃতিই। সে রাতে সিডরের তান্ডবে ক্ষয়ক্ষতি আরো ভয়াবহ আকার ধারন করত যদি উপকূলীয় সোয়া দু’লাখ হেক্টরের বিশাল সবুজ বেষ্টনী ও পরিকল্পিত বনভূমি না থাকত। পাশাপাশি প্রকৃতির অপারদান আমাদের সুন্দরবন সে রাতে সিডরকে বুক পেতে মোকাবেলা করে। প্রকৃতির তান্ডব সামাল দিতে সে রাতে উপকূলীয় বনায়ন কর্মসূচী ও সবুজ বেষ্টনীর লক্ষ লক্ষ গাছ ছাড়াও সাধারন মানুষের প্রায় ১ কোটি গাছ মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল। সুন্দরবন সহ গোটা উপকূলীয় বনভূমির ক্ষতিও ছিল ব্যাপক।
সিডরের সে তান্ডবে উপকূলীয় এলাকার প্রায় পৌনে ৭শ কিলোমিটার আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়ক সহ পল্লী যোগাযোগ অবকাঠামো সম্পূর্ণ এবং প্রায় ৯০ হাজার কিলোমিটার গ্রামীন সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিধ্বস্ত এলাকার প্রায় ১৮শ সরকারিÑবেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ও প্রায় সাড়ে ৬ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।  বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের ১,৬৫৪টি সেতু এবং কালভার্ট সম্পূর্ণ ও প্রায় ৯শ টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সিডরের তান্ডবের পরদিন সকাল থেকেই স্থানীয় প্রশাসন ছাড়াও সশস্ত্র বহিনীর জওয়ানরা উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছিলেন। রেড ক্রিসেন্ট-এর ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী-সিপিপি‘র সে সময়ের ৪০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক সিডরের দিন সকাল থেকে উপকূলের কয়েক লাখ মানুষকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে স্থানান্তর সহ দুর্যোগ পরবর্তি উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়। নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে উদ্ধার করতে গিয়ে সিপিপির অন্তত ৭জন স্বেচ্ছাসেবক প্রাণ হারিয়ে ছিলেন। ১৭ নভেম্বরের মধ্যে দুর্যোগ কবলিত বেশীরভাগ এলাকায় সেনাবাহিনী ও রেড ক্রিসেন্টের সেচ্ছাসেবকরা পৌছে ত্রাণ বিতরণ করতেও সক্ষম হন। ১৬ নভেম্বর রাতের মধ্যে বরিশালÑফরিদপুরÑঢাকা জাতীয় মহাসড়ক এবং ১৮ নভেম্বর বরিশালÑপটুয়াখালীÑকুয়াকাটা ও বরিশালÑবরগুনা মহাসড়কে ফেরিবিহীনভাবে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। তবে পরিপূর্ণ সড়ক পরিবহন পুনর্বহাল করতে আরো ১৫ দিন  পেরিয়ে যায়। বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুনর্বাসনে প্রায় আড়াই মাস সময় লেগেছিল।
প্রথমদিকে আকাশ পথেই ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করে সেনা ও বিমান বাহিনী। সাথে বাংলাদেশ নৌবাহিনীও উপকূলের দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতে ত্রাণ তৎপরতায় অংশ নেয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন প্রথমে ত্রাণ তৎপরতা শুরু করলেও পরবর্তিতে দেশী বিদেশী বিভিন্ন পর্যায় থেকেও ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হয়।
প্রায় ৪০টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সাহায্যÑসহযোগীতার আশ্বাস দিলেও পরবর্তিতে ৩২টি দেশ আর কোন সাড়া দেয়নি। এমনকি ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরবর্তি প্রেসিডেন্ট প্রনব মুখার্জীও বরিশাল বিমানবন্দর হয়ে শরনখোলার ঘূর্ণি উপদ্রƒত এলাকা সফর করে সেখানের কয়েকটি গ্রামের দুর্গতদের ঘরবাড়ী নির্মান করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন হয় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর। পাকিস্তান সরকার সেদিন বাংলাদেশের ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকায় বিমান বাহিনী ও সেনা বাহিনীর সদস্যদের পাঠিয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল। একই সাথে মার্কিন মেরিন সেনারাও ঘূর্ণি উপদ্রুত উপকূলীয় এলাকাতে পানি সরবরাহ ও চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছিল। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তি কৃষি পুনর্বাসন ও কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে ইউএসএইড মাঠ পর্যায়ে গুটি ইউরিয়া উৎপাদন ও প্রয়োগে সহায়তা করে। ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যায় হ্রাস সহ অধীক ফসল উৎপাদনে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। সিডরের কালোরাত্রির সে ভয়াল দুর্যোগ গোটা উপকূলবাসীকে আজো তাড়া করছে। স্বজনহারাদের আর্তনাদে উপকূলের বাতাস এখনো ভারি হয়ে ওঠে। জীবনমানে পিছিয়ে পড়া স্বজনহারা সাগর উপকূলের অনেক মানুষের চোখে আজও চরম হতাশার সাথে অবশিষ্ট আছে শুধু সাগরের গর্জন। তারপরেও প্রকৃতির একের পর এক তন্ডব থেকে বেঁচে যাওয়া উপকূলের সর্বশান্ত কোটি মানুষ একের পর এক ঝড়-জলোচ্ছাসের সাথে লড়াই করেই টিকে আছেন।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT