4:04 pm , November 13, 2024
আজ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস
ডাঃ মনজুর উর রহমান, ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ ও কনসালট্যান্ট ॥ নিঃসন্দেহে বর্তমানে ডায়াবেটিস একটি প্রধান বৈশ্বিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যতগুলো দিবস আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পালন করা হয়, ডায়াবেটিস দিবস তাদের মধ্যে অন্যতম। অসংক্রামক ব্যাধির তালিকায় এ রোগের অবস্থান সবার উপরে এবং বর্তমান সময়ে যে হারে বা গতিতে ডায়াবেটিস বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে অনেক রোগিরা বা আক্রান্ত ব্যক্তিরা মনে করছেন এটা বুঝি ছোঁয়াছে কিংবা সংক্রামক রোগের মতোই। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ রোগ কোনভাবেই ছোঁয়াছে বা সংক্রামক নয় বরং এটা শতভাগ হরমোন ঘটিত রোগ। মানবদেহে ইনসুলিন নামক এক প্রকার হরমোনের অভাব হলে বা উৎপাদিত ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমে গেলে রক্তের গ্লুকোজ প্রয়োজন অনুসারে দেহের কোষে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে যায়। এই অবস্থার নাম-ই হলো ডায়াবেটিস। আধুনিক সভ্যতার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, মানুষের পরিবর্তিত জীবনধারা, পরিবেশ দূষন, মানসিক চাপ, অর্থনৈতিক দৈন্যতা, অলসতা, শারীরিক কর্ম বিমুখতা ইত্যাদি নানা কারনে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। ডায়াবেটিস নিঃসন্দেহে একটি জটিল, ভয়ানক ও নিরব ঘাতক। এটা সার্দি, কাশি, জ্বর বা ডাইরিয়ার মতো কোন রোগ নয়। এই রোগ গোটা শরীরটাকেই প্রভাবিত করে যা তাকে সারাজীবন-ই বয়ে বেড়াতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ঘরে ঘরে ডায়াবেটিস রোগী। বেশীর ভাগ রোগীরা এখনও পুরোনো ধাঁচের চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। রোগের শুরুতে অনেকেই হার্বাল, আয়ুর্বেদীয় অথবা ইউনানী কিংবা হোমিও চিকিৎসা গ্রহন করে থাকেন। কেউ কেউ এতে সাময়িক স্বস্তি পেলেও জটিলতা তাদের পিছু ছাড়ে না। ফলে অনেক রোগীরাই এ রোগের সুদূর প্রসারী জটিলতা সমূহের কবলে পতিত হয়। ডায়াবেটিসের দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা সমূহের মধ্যে রয়েছে- হৃদরোগের ঝুঁকি, চোখে ঝাঁপসা দেখা, অন্ধত্ব, কিডনী বিকল হওয়া, স্নায়ুবিক ক্ষয়ক্ষতি (হাত-পা), ব্রেন মস্তিস্ক আক্রান্ত হওয়া, মুখ বেঁকে যাওয়া (বেলস পালসি), দাঁত ও মুখ গহ্বর সংক্রান্ত জটিলতা, মাড়ির রোগ, চর্মরোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। বেশির ভাগ জটিলতার মূল কারন গুলো হচ্ছে : দেরী করে চিকিৎসা গ্রহন, বিলম্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়া, রোগের শুরুতে অবহেলা বা দোকানে গিয়ে শুনে শুনে ঔষধ খাওয়া, পরীক্ষা নিরীক্ষা না করানো, সর্বোপরি এ রোগ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব, সচেতনতার অভাব। ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে কিছু আলোচনা প্রয়োজন। প্রথমত এ রোগের প্রকোপ থেকে এবং জটিলতা এড়িয়ে চলতে হলে ঝুঁকি থেকে দূরে থাকতে হবে। খাদ্য অভ্যাসের পরিবর্তন করতে হবে। নিয়মিত হাঁটা, ব্যায়াম অথবা সাঁতার কাটা কিংবা সাইকেল চালানো এগুলোর কোন বিকল্প নেই। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া এ রোগের চিকিৎসা করা কারো জন্য শোভনীয় নয়। ডায়াবেটিস চিকিৎসা সর্বাঙ্গীন হওয়া উচিত এবং সেইসব ঔষধ অথবা ইনসুলিন দিয়েই চিকিৎসা করা উচিৎ যেগুলো রক্তে শর্করার মাত্রা কমানোর সাথে সাথে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে। অশিক্ষা, ভ্রান্ত শিক্ষা, কুসংষ্কার, ধর্মান্ধতা, ডায়াবেটিসের সঠিক চিকিৎসার পথে প্রধান অন্তরায় বা বাঁধা। এদেশে একদল আসাধু ব্যবসায়ী চক্র বা সিন্ডিকেট রয়েছে যারা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই বিভিন্ন উদ্ভিদের ফল, লতা, শিকড়, বিচি ইত্যাদি ব্যবহার করে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে এসব চিকিৎসার কোন সুস্পষ্ট প্রমান বা দলিল নাই। যেহেতু ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘ মেয়াদী ব্যয়বহুল ও জটিল রোগ তাই এই রোগের চিকিৎসাও নিয়মতান্ত্রিকভাবেই করা উচিত বলে আমি মনে করি। শুধুমাত্র ঔষধ বা ইনসুলিনের মাত্রা বৃদ্ধি করে ছেড়ে দেওয়াটা অপরিপক্কতা ও ক্ষতিকারক একটা চিকিৎসা ছাড়া আর কিছুই নহে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রন যেমন জরুরী তেমনি এর জটিলতা রোধ করাও আরো বেশি জরুরী। এই রোগের ঝুঁকি সমূহ, ঝুঁকির কারন সমূহ এবং করনীয়গুলো অবশ্যই জানতে হবে এবং জানাতে হবে। প্রতিটি সচেতন নাগরিকের এ সম্পর্কে সম্যক ধারনা থাকা এবং সঠিক জ্ঞান অর্জন- এখন সময়ের দাবী। এক্ষেত্রে মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সভা-সেমিনার, ফ্রি- ক্যাম্পেইন ইত্যাদি কাজগুলোকে উৎসাহিত করা যেতে পারে এবং এগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। পোষ্টার, ব্যানার, ফেষ্টুন এগুলোর মাধ্যমে মানুষ সচেতন হতে পারে। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যেমন : শিক্ষক, শিক্ষা উন্নয়নকর্মী, শিক্ষা সাংবাদিক, আইন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ, চিকিৎসক ও স্বাস্থকর্মী, উপাসনালয়ের ধর্মীয় ব্যক্তিরা এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারেন। ১৯২১ সালে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী স্যার ফ্রেডরিক বেন্টিং ও তার সহযোগী ম্যাকলয়েড এর সাথে যৌথভাবে ইনসুলিন আবিস্কার করে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। এই মহান আবিষ্কারের নেপথ্যে আরেকজন বিজ্ঞানীর ভূমিকাও ছিলো অসামান্য। তার নাম চার্লস বেষ্ট। ১৪ই নভেম্বর ছিল ফ্রেডরিক বেন্টিং এর জন্মবার্ষিকী। তাই বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসাবে এই তারিখকেই ওউঋ ও ডঐঙ কর্তৃপক্ষ বেছে নিয়েছিল।