4:06 pm , November 11, 2024
ভয়াল ঘূর্ণিঝড় হেরিকেন এর কালোরাত আজ
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ প্রকৃতির রুদ্র রোশের শিকার উপকূলবাসীর কাছে ‘ভয়াল ১২ নভেম্বর’ আজ। দেশের উপকূলের ৭১০ কিলোমিটার এলাকার দেড় কোটি মানুষের এক বিভীষিকার এ রাতটির কথা মনে করে আজো সবাই শিউরে ওঠেন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর রাতে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা প্রায় ৩০ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস নিয়ে আড়াইশ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় ‘হেরিকেন’ উপকূলের বিশাল জনপদের প্রায় ৫ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। ভয়াল সে কালোরাতে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ নিখোঁজ হলেও তাদের বেশীর ভাগেরই ঠিকানা ছিল না ফেরার দেশে। ফুসে ওঠা বঙ্গোপসাগরের জলোচ্ছ্বাস সে রাতে লক্ষাধীক মানুষকে ভাসিয়ে নেয়ায় তাদের সলিল সমাধী ঘটে। নিকটজনেরা তাদের লাশেরও কোন সন্ধান পায়নি।
মৃত্যু আর ধ্বংস নিয়ে প্রতিবারের মত ’৭০-এর ১২ নভেম্বর হেরিকেন-এর তান্ডবে উপকূলের ৭১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যে ভয়াবহ বিভীষিকা নেমে এসেছিল তা আজো গোটা বিশ্বে বিরল। কোন প্রকৃতিক বিপর্যয়ে একইরাতে এত মৃত্যু আর কখনো দেখেনি গোটা বিশ^। সে রাতে উপকূলের এমন কোন পরিবার ছিল না যাদের কেউ না কেউ নিহত বা নিখোঁজ হননি।
মার্কিন উপগ্রহ থেকে প্রথম ঐ ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা তৎকালীন পাকিস্তান আবহাওয়া বিভাগকে দেয়া হলেও সময়মত উপকূলবাসীকে সতর্ক করা সহ তাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়ার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে জানমালের ক্ষতি অনেকগুনই বেড়ে যায়।
এখনো নভেম্বর এলেই গোটা উপকূলীয় জনপদের মানুষ চরম আতঙ্কে থাকেন। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে হেরিকেন-এর অনুরূপ ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ২০ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস মাথায় করে আড়াইশ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে এসে বরিশাল, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনা ও পিরোজপুরের বিশাল এলাকাকে লন্ডভন্ড করে দেয়। ২০২০ সালেল ১১ নভেম্বর সকালে আরেক ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আছড়ে পড়েছিল। সুন্দরবন সহ উপকলীয় বনভূমি সে ঝড়কে প্রতিহত করায় দুর্বল হয়ে যায়।
বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমানাজুড়ে বিস্তীর্র্ণ জলরাশির সঞ্চালন সুনীল ঢেউ-এর মাথায় যে রুপালী ঊর্মিমালা আলিঙ্গন করছে, বিশ্ব মানচিত্রে তা-ই বঙ্গোপসাগর। পৃথিবীর অন্য সব সাগরের মতই প্রকৃতির সব লীলার সঙ্গিনী হয়ে মেতে আছে আমাদের অবিচ্ছেদ্য বঙ্গোপসাগরও। প্রকৃতির সাথে বঙ্গোপসাগরের বিচিত্র লীলার যে ভয়ঙ্কর রূপ, তার অস্তিত্ব অনুভব করতে গিয়ে দেশের উপকূলবাসীকে বার বারই ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হয়েছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপ ঘূর্ণিঝড়ের রূপ ধরে উপকূলে ছোবল হানছে শতাব্দীর পর শতাব্দী।
প্রকৃতির রুদ্র রোষে গত দুই শতকে উপকূলভাগের অন্তত ২৫ লাখ মানুষের প্রানহানী ঘটেছে। সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমানও ১০ লাখ কোটি টাকারও বেশী। এরপরেও প্রকৃতির সাথেই লড়াই করে বেঁচে আছেন দেশের দক্ষিণ উপকূলের দেড় কোটি মানুষ। তবে একের পর এক প্রকৃতির তান্ডব অব্যাহত থাকলেও এখনো দুর্যোগের হাত থেকে উপকূলবাসীর নিরাপদ আশ্রয় সহ প্রাণী ও মৎস্য সম্পদ রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হয়নি। তবে আগাম সতর্কতার কারনে প্রাণহানীর সংখ্যা আশাতীতভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
পাশাপাশি প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে ৫ লক্ষাধিক মানুষের নিরাপদ আশ্রয় সম্ভব হলেও বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো নিরাপত্তার বাইরে। তবে প্রাণী সম্পদের আশ্রয় এখনো বেদানাদায়ক। মৎস্য সম্পদ আরো ঝুাকিপূর্ণ। প্রকৃতির এ রুদ্র লীলায় বার বারই দক্ষিণ উপকূলভাগের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা চরম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের অর্থনীতিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এমনকি বার বার প্রকৃতির তান্ডবে দক্ষিণ উপকূলের অর্থনীতি আজো সারা দেশ থেকে অনেক পেছনে।
বিজ্ঞানের প্রসারের ফলে ঘূর্ণিঝড়ের উৎপত্তির কারণ ও এর গতিপথ নির্ণয় সম্ভব হলেও নিয়ন্ত্রন আজো মানুষের সাধ্যের বাইরে । তবে সময়মত সতর্ক করার ফলে প্রাণহানীর সংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হচ্ছে। টেকসই অবকাঠামো নির্মানে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতিও কিছুটা হ্রাস পেলেও প্রকৃতি নির্ভর উপকূলীয় কৃষি ব্যবস্থা বারবারই বিপর্যস্ত হচ্ছে। ফলে ক্ষুধা আর দারিদ্রতা দক্ষিণ উপকূলবাসীর জীবনসঙ্গী হয়ে আছে।
’৭০-এর ১২ নভেম্বর রাতে হেরিকেন এর তান্ডবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সহ গোটা পাকিস্তানের সর্বাধিক অনুন্নত ও দারিদ্র পীড়িত উপকূলীয় এলাকা আরো একবার বিপন্ন হওয়ার পরে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য অবশিষ্ট ছিল শুধু সাগরের গর্জন আর শব মিছিল। ধংসস্তূপ থেকে ভেসে আসছিল স্বজন হারাদের কান্নার রোল। বিশুদ্ধ পানি, খাবার আর বসনের সাথে মাথার ওপর ছাউনির অভাবে উপকূলের বেশীরভাগ এলাকার বাতাসই দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে গিয়েছিল। সৃষ্টি হয়েছিল চরম মানবিক বিপর্যয়। হেরিকেনের তান্ডব উপকূলের শত শত মাইলজুড়ে শুধু বিধ্বস্ত জনপদ, লাশের মিছিল আর জনবসতীর ধংসস্তূপের চিহৃ রেখে গিয়েছিল। হেরিকেনের তান্ডবে বেঁচে যাওয়া অন্ন-বস্ত্র আর মাথা গোঁজার ন্যূনতম ঠাঁইবিহীন মানুষের জীবনে চরম অনিশ্চয়তা নেমে এলেও পাকিস্তান সরকারের ত্রাণ তৎপরতা শুরু হয় অন্তত ১৫ দিন পরে। এরপরেও প্রকৃতির একের পর এক রুদ্র রোষ থেকে বেঁচে যাওয়া উপকূলের মানুষগুলো প্রকৃতির সাথে লড়াই করে টিকে আছে আজো।
’৭০-এ ১২ নভেম্বর কালোরাত্রীর সে বিভীষিকা আজো উপকূলের বয়োজ্যেষ্ঠদের তাড়া করছে। স্বজনহারা সব বয়সী মানুষ বড় দুঃসহ যান্ত্রনা নিয়েই স্মরণ করছেন ভয়াল ১২ নভেম্বরকে। হেরিকেন-এর ছোবলে নিহতদের স্মরণে আজো বিভিন্ন এলাকায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।