3:31 pm , November 5, 2024
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ মেঘনা অববাহিকা সহ পুরো বরিশাল অঞ্চল শেষ রাতে হালকা থেকে মাঝারী কুয়াশায় ঢেকে গেলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের ওপরে উঠে যাচ্ছে। আবহাওয়ার এ বৈপরীত্য জনস্বাস্থ্যের সাথে কৃষি এবং প্রকৃতিতেও নানা ধরনের বিরুপ প্রভাব ফেলছে। আবহাওয়ার এ আচরনে বরিশাল অঞ্চলজুড়ে জ¦র সহ ঠান্ডাজনিত নানা সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বয়োবৃদ্ধ সহ নানা বয়সের মানুষ। একই সাথে হেমন্তের অতিবর্ষণে ফসল নিয়ে বিপাকে কৃষিযোদ্ধারা। পুরো বর্ষা মৌসুমজুড়ে বৃষ্টির দেখা না মিললেও শরতের শেষপ্রান্ত থেকে হেমন্তের শেষভাগেও অসময়ের অতিবর্ষণ কৃষিকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। অথচ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বরিশাল উপকূল থেকে বিদায় হয়েছে আরো প্রায় ২০দিন আগে।
কিন্তু এর পরেও ঘূর্ণিঝড় দানায় ভর করে সদ্যসমাপ্ত অক্টোবরে বরিশালে স্বাভাবিকের ৬২.১% বেশী বৃষ্টি হয়েছে। হেমন্তের শেষ প্রান্তেও স্বাভাবিকের অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে বরিশাল অঞ্চলজুড়ে মশাবাহী রোগ ডেঙ্গুর দাপট অব্যাহত রয়েছে। পুরো বছরজুড়ে যে সংখ্যক রোগী সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন, শুধু অক্টোবরেই তার প্রায় সমান ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর শুধু অক্টোবরেই মারা গেছেন আরো ১৭ জন। চলতি মাসেও আক্রান্তের সাথে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
বর্তমানে শেষ রাতের কুয়াশার দাপট শীতের আগাম বার্তা দিলেও বেলা বাড়ার সাথে তাপমাত্রার পারদ স্বাভাবিকের ওপরে উঠে যাওয়ায় জনজীবনে অস্বস্তি বাড়ছে। আবহাওয়া বিভাগের মতে হেমন্তের মধ্যবর্র্তী অক্টোবরে বরিশালে দিনের সর্বোচ্চ স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩১.৬ ডিগ্রী থাকার কথা। কিন্তু গতমাসে তা ৩৫-৩৬ ডিগ্রীতেও উন্নীত হয়েছিল। আবার চলতি নভেম্বরে বরিশালের দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যেখানে ২৯.৬ ডিগ্রী থাকার কথা, সেখানে মাসের প্রথম দিনেই তা ছিল প্রায় ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। মঙ্গলবার দুপুরেও বরিশালে তাপমাত্রার পারদ ছিল প্রায় ৩৪ ডিগ্রীর কাছে। অপরদিকে চলতি মাসে দিনের সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ১৮.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াসের স্থলে তা প্রায়দিনই ২৫ ডিগ্রী ছুঁয়ে যাচ্ছে।
অথচ মূল বর্ষা মৌসুমে এবার বৃষ্টির অকালে বরিশালে আউশের আবাদ লক্ষ্য ২ লাখ ১০ হাজার হেক্টর থাকলেও তা মাত্র ১ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টরে সীমিত ছিল। ঘূর্ণিঝড় রিমাল এর প্রভাবে আরো আড়াই হাজার হেক্টরের ধান সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে। ফলে আউশ উৎপাদন লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ায় প্রায় ১৪ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত বরিশাল কৃষি অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তায় একটি বড় ধাক্কা লেগেছে। সদ্য সমাপ্ত খরিপ-১ মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে আউশের উৎপাদন ৫ লাখ ৭০ হাজার হেক্টরের স্থলে প্রকৃত উৎপাদন মাত্র ৩.৪৫ লাখ টনে নেমে এসেছে।
অপরদিকে বিগত ভাদ্রের পূর্ণিমার প্রবল বর্ষণ সহ ফুসে ওঠা সাগরের প্লাবনের সাথে উজানের ঢলে পুরো গ্রীষ্মকালীন সবজি সহ আগাম শীতকালীন সবজির আবাদ যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, এবার মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির অভাবে আউশ বীজতলা তৈরী ও রোপন যেমনি বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি রোপা আউশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে। এমনকি গতমাসে আশি^নের পূর্ণিমার প্রভাবে অতিবর্ষণ ছাড়াও ঘূর্ণিঝড় দানার ফলে বরিশাল উপকূলের উঠতি আউশ ধানের ক্ষতি হয়েছে।
জানুয়ারী ও ফেব্রুয়ারী মাসে বরিশালে কোন বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু মার্চে ৩০ ভাগ এবং এপ্রিলে ৮৬% কম বৃষ্টির পরে ঘূর্ণিঝড় রিমাল-এ ভর করে মে মাসে স্বাভাবিকের প্রায় ৫০ ভাগ বেশী বৃষ্টি হয়। কিন্তু জুন মাসে প্রায় ৬০ ভাগ এবং জুলাই মাসেও স্বাভাবিকের প্রায় ৩১ ভাগ কম বৃষ্টির প্রভাব পড়ে বরিশালের ফসলের মাঠে। আবার ভাদ্রের পূর্ণিমায় ভর করে লাগাতার প্রবল বর্ষণে আগষ্ট মাসে ৬২% বেশী বৃষ্টিপাতে উঠতি আউশ আরেক দফা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেপ্টেম্বর মাসেও স্বাভাবিকের প্রায় ৫২% বেশী বৃষ্টির পরে অক্টোবরে স্বাভাবিক ১৭০ থেকে ২শ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়া হলেও বাস্তবে গত মাসে বরিশালে স্বাভাবিকের ৬২.১% বেশী ২৮৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
গত কয়েক বছর ধরেই ঘূর্ণিঝড়-প্লাবনের সাথে অস্বাভবাবিক বজ্রপাত সহ অসময়ের অতিভারী বর্ষণের সম্মুখিন হচ্ছে পুরো বরিশাল সহ তৎসংলগ্ন উপকূলীয় অঞ্চল। তবে প্রকৃতির এ বৈরী আচরণকে ‘জলবায়ুর বিরুপ প্রভাব’ বলে মানতে চাচ্ছেন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। তারা প্রকৃতির এ অস্বাভাবিক আচরনকে ‘জলবায়ুর ধারবাহিকতার সাময়িক দৃশ্যমান বিচ্যুতি’ বলে মনে করছেন।