4:02 pm , November 3, 2024
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ নিরাপদ প্রাকৃতিক পরিবেশে ইলিশের নির্বিঘœ প্রজননের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে টানা ২২ দিনের আহরণ, পরিবহন ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে গত মধ্যরাতে। ফলে বরিশাল উপকূল এলাকার জেলে পল্লী সহ মৎস্য আড়তগুলো আবার কর্মচঞ্চল হয়ে উঠেছে। মধ্যরাত থেকেই জেলেরা মাছ ধরার নৌকা-ট্রলার নিয়ে নদী ও সাগরে যেতে শুরু করেছেন। আড়ৎদার ও মহাজনরা দাদন (অগাম মাছের দাম) দিয়ে জেলেদের সাগর ও নদীতে পাঠানোর কাজটি চূড়ান্ত করেছে। বরিশালের পোর্ট রোড মৎস্য আড়তেও আজ থেকে ইলিশ আসতে শুরু করবে। পাশাপাশি আলীপুর-মহীপুর, হরিনঘাটা, পাড়েরহাট, চর মোন্তাজ, ঢালচর, চর কুকরী-মুকরী সহ উপকূলের সব মৎস্য আড়তগুলো ইতোমধ্যে প্রস্তুত হয়েছে। দেশে আহরিত প্রায় ৫.৮০ লাখ টন ইলিশের ৭০ভাগই বরিশাল অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় এলাকায় উৎপাদন ও আহরণ হচ্ছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞার এ সময়ে বিগত বছরগুলোর মত এবারো বাংলাদেশের উপকূল সহ সমুদ্র সীমায় ভারতীয় অনেক জেলে নৌকা ও ট্রলার অবৈধভাবে প্রবেশ করে মাছ লুটে নিয়েছে। এবছর বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর হাতে অন্তত ১০টি ভারতীয় ট্রলার আটক করে। গত কয়েক বছর ধরে নিরাপদ প্রজননের ২২দিন এবং সাগরে মৎস্য আহরণে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে ভারতীয় শত শত ট্রলার অবৈধভাবে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমায় প্রবেশ করে মাছ লুটে নিয়েছে।
ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নির্বিঘœ করতে দেশের উপকূলের ৭ হাজার ৩৩৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সব ধরনের মাছ সহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে ইলিশ আহরণ,পরিবহন ও বিপণনে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয় গত ১৩ অক্টোবর মধরাতে। এবারো এ নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে দেশের দক্ষিণ উপকূলের ৩৭টি জেলার ১৫৫টি উপজেলার ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৬৫ জেলেকে মানবিক খাদ্য সহায়তা হিসেবে ১৪ হাজার ১৬৫ টন চাল দেওয়া হয়েছে।
এবছর বরিশাল সহ দক্ষিণ উপকূলে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মৎস্য আহরণ প্রবনতা অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশী লক্ষ্য করা গেছে। যদিও নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় মৎস্য বিভাগ বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা ছাড়াও ভ্রাম্যমান আদালত বসিয়ে জেল-জরিমানা সহ নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
মৎস্য অধিধপ্তরের মতে গত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময়ে বরিশাল সহ উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ১০ হাজার অভিযান ছাড়াও ২ সহ¯্রাধিক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে প্রায় ২ হাজার জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রায় ৭০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। একই সময়য় নিষিদ্ধ ঘোষিত প্রায় ৬ কোটি মিটার জাল বাজেয়াপ্ত করে পুড়িয়ে ফেলা হয়। এছাড়া বিভিন্ন মৎস্য উপকরন বাজেয়াপ্ত করে নিলামে বিক্রী করে সরকারের আয় হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। অভিযানকালে প্রায় ৫৫ টন ইলিশ আটক করে বিভিন্ন এতিমখানা ও লিল্লøাহ বোর্ডিং-এ দান করা হয়েছে। এসময় আইন ভঙ্গের অভিযোগ আরো প্রায় ৩ হাজার মামলা দায়ের করা হয়েছে জেলে সহ মৎস্যজীবীদের বিরুদ্ধে। নিষেধাজ্ঞার এ সময়ে মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পুলিশ-প্রশাসনের সহায়তায় প্রায় ৫০ হাজার মৎস্য আড়ৎ, বাজার, মাছঘাট পরিদর্শন করে ইলিশ বিপণন নিয়ন্ত্রনে কাজ করেছে।
মৎস্য অদিদপ্তরের মতে, সারা বিশে^র ৬০%-এরও বেশী ইলিশ এখন বাংলাদেশেই উৎপাদন হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে জাতীয় মাছ ইলিশের একক অবদান এখন ১%-এর বেশী। আর মৎস্য খাতে অবদান প্রায় ১২.৫০%।
আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে পরের ২২ দিন আহরণ ও বিপণন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশের প্রজনন সময় কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করে মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে এসময় কিছুটা হেরফের করা হচ্ছে।
‘হিলসা ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্লান’এর আওতায় ২০০৫ সালে প্রথম প্রধান প্রজনন মৌসুমে ১০ দিন ইলিশের আহরণ বন্ধ রাখা হয়। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে ২০১১ সালে তা ১১ দিন এবং ২০১৫ সালে ১৫ দিন ও ২০১৬ সাল থেকে ২২ দিনে উন্নীত করা হয়। ইলিশ নিয়ে নানামুখি গবেষনা ভিত্তিক বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশে ইলিশের উৎপাদন একসময়ের ১.৯৮ লাখ টন থেকে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৫.৬৫ লাখ এবং সদ্য সমাপ্ত অর্থ বছরে তা ৫.৮০ লাখ টনে উন্নীত হতে পারে বলে মৎস্য বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
ইলিশের প্রজননক্ষেত্র ও মাইগ্রেশন পথ নির্বিঘœ রাখা সহ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুত ও জীব বৈচিত্রকে সমৃদ্ধ করতে ইতোমধ্যে নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম ‘সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা বা মেরিন রিজার্ভ এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছে। পাশাপাশি গত ২২দিনে মা ইলিশ যে ডিম ছেড়েছে তা থেকে লার্ভা হয়ে ইলিশ পোনা সংরক্ষণে গত ১ নভেম্বর থেকে ৮ মাসের জন্য জাটকা আহরণ,পরিবহন ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। এসময়ে বরিশাল উপকূলের ৬টি এলাকাকে দু’মাস করে ‘অভয়াশ্রম’ ঘোষনা করে সব ধরনের মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে।
প্রতিদিন ¯্রােতের বিপরীতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলা অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ জীবনচক্রে স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, উপকূলের ৭ হাজার ৩৩৪ বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্ত ভাসমান অবস্থায় ছাড়া ডিম থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা, স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে বিচরন করে খাবার খেয়ে বড় হতে থাকে। অভয়াশ্রমের ‘নার্সারী ক্ষেত্র’সমূহে ৭Ñ১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়াবার পরে জাটকা হিসেবে সমুদ্রে গিয়ে পরিপক্কতা অর্জন করে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২Ñ১৮ মাস অবস্থানের পরে পরিপক্ক হয়েই পূর্র্ণাঙ্গ ইলিশ হিসেবে প্রজননের লক্ষ্যে আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের ইকোসিষ্টেমে সারা বছরই ৩০% ইলিশ ডিম বহন করে। এসব ইলিশ পরিপক্ক হয়ে ডিম ছাড়ে। যে ডিমগুলো পুরুষ ইলিশ দ্বারা নিষিক্ত হয়ে থাকে, তা নতুন প্রজন্ম গঠন করে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের গবেষনায় দেখা গেছে, নজরদারী বৃদ্ধির ফলে দেশে ইলিশপোনা-জাটকার উৎপাদন ২০১৫ সালে ৩৯ হাজার ২৬৮ কোটি থেকে ২০১৭ সালে ৪২,২৭৪ কোটিতে উন্নীত হয়। ২০২২ সালের প্রজনন মৌসুমে দক্ষিণ উপকূল সহ সংলগ্ন অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে প্রায় ৮৪% মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। এরমধ্যে ৫২ ভাগ মা ইলিশ ২২ দিনের মূল প্রজননকালীন সময়ে এবং আরো ৩২% ডিম ছাড়ারত ছিল। যা ছিল অগের বছরের প্রজননকালের চেয়ে প্রায় ২.৪৫% বেশী। ফলে ওই বছর ৪৩ হাজার কোটিরও বেশী জাটকা ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছে বলে মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট এর দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। ২০১৮ সালের আহরণ নিষিদ্ধকালে উপকূলের প্রজননস্থল সহ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ৪৮% মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পেলেও ২০১৭ সালে তা ৭৩% এবং ’১৮ সালে ৯৩%-এ উন্নীত হয়। পাশাপাশি এসময়ে প্রজনন সাফল্য ৮০% এ উন্নীত হয়েছিল।