2:54 pm , October 18, 2024
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ আবহাওয়ার স্বাভাবিক আচরণ বিচ্যুতির ফলে ঝুঁকির মুখে বরিশাল অঞ্চলের কৃষি ও জনস্বাস্থ্য সহ স্বাভাবিক পরিবেশ। ভরা বর্ষায় বৃষ্টির আকালের পরে শরৎ পেরিয়ে হেমন্তের বর্ষণে ডুবছে বরিশাল মহানগরী সহ আশপাশের এলাকা। গত বৃহস্পতিবার বিকেল সোয়া ৪টা থেকে সন্ধ্যা সোয়া ৬টার মধ্যে দেশের সর্বাধিক, ৫৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে পুরো বরিশাল মহানগরী সহ এ অঞ্চল আরেকবার পানির তলায় চলে যায়। সপ্তাহের শেষ কর্ম দিবসে অফিস ফেরত নারী-পুরুষের দুর্ভোগ ছিল বর্ণনাতীত। পুরো মহানগরীর কোথাও নির্বিঘœ পথ চলা দূরের কথা যানবাহনও চলতে পারছিলনা হেমন্তের অতি বর্ষণের পানি আটকে যাওয়ায়। আবহাওয়া বিভাগ থেকে বরিশাল সংলগ্ন উত্তর বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের বর্ধিতাংশ অবস্থানের কথা জানিয়ে আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে আরো একটি লঘুচাপ তৈরীর কথা জানানো হয়েছে। তবে বরিশাল সহ এ অঞ্চলের সবগুলো নদী বন্দরকে সতর্ক সংকেত নামিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে।
মেঘের গর্জনের সাথে প্রবল বর্ষণে বরিশালের অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রীবাহী নৌযানগুলো আটকে যায় কয়েকস্থানে। বিমান বন্দরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-এর পূর্ণ লোডের একটি উড়ান নিয়ে পাইলটের কপালের ভাজ ক্রমে গভীর হলেও শেষ পর্যন্ত ঢাকায় কন্ট্রোল টাওয়ার ‘বরিশাল-ঢাকা আকাশ পথের পূর্ণ নিরপত্তার বার্তা’ দেয়ায় ৪৫ মিনিট বিলম্বে আকাশে ওড়ে জাতীয় পতাকাবাহী বিমান।
গত কয়েক বছর ধরে ঘূর্ণিঝড়-প্লাবন, অস্বাভাবিক বজ্রপাত, অসময়ের অতিভারী বর্ষণের সম্মুখিন হচ্ছে পুরো বরিশাল সহ সংলগ্ন উপকূলীয় অঞ্চল। প্রকৃতির এ বৈরী আচরণকে ‘জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব’ বলতে চাননা আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। কেউ কেউ একই মৌসুমে ঘন ঘন আবহাওয়া পরিবর্তনকে ‘জলবায়ুর ভারসাম্যহীনতা’ বলে মনে করছেন। প্রকৃতির এ অস্বাভাবিক আচরণকে ‘জলবায়ুর ধারাবাহিকতার সাময়িক দৃশ্যমান বিচ্যুতি বলেও মনে করছেন অনেকে। গত কয়েক বছর ধরে সারা দেশের মত বরিশাল অঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় এবং উজানের ঢলের সাথে ফুঁসে ওঠা সাগরের জোয়ারের প্লাবন ও মূল বর্ষাকালে বৃষ্টির আকালের পরে অসময়ে অতিমাত্রায় ভারী বর্ষণের সাথে বজ্রপাতে জানমাল সহ ফসলের ক্ষতি বাড়ছে। বর্ষা পেরিয়ে ভাদ্র-আশি^ন-কার্তিকের বর্ষণ ও প্লাবনে ১৪ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত দক্ষিনাঞ্চলের আউশ, আমন ও বোরো ধান সহ রবি ফসল নিয়ে কৃষকের দুঃশ্চিন্তা বাড়ছে। চলতি খরিপ-২ মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে ৮ লাখ ৮১ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ২৪ লাখ টন আমন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যে রোপনের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছেন কৃষি যোদ্ধারা। কিন্তু অসময়ের অতিভারী বর্ষণ পরিস্থিতি কোনদিকে নিয়ে যাবে তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তার মাত্রা বাড়ছে।
চলতি বছরের শুরু থেকে অনাবৃষ্টির পরে গত মে মাসে ঘূর্ণিঝড় রিমাল’এ ভর করে বরিশালে স্বাভাবিকের প্রায় ৫০ ভাগ বেশী বৃষ্টি হলেও জুন ও জুলাই মাসে বৃষ্টিপাতের ব্যাপক ঘাটতি ফসল আবাদ ও উৎপাদন সহ সুস্থ পরিবেশকে বিপন্ন করে তোলে। মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টির অভাবে বিগত খরিফ-১ মৌসুমে দেশের প্রায় ৩০ ভাগ আবাদী এলাকা বরিশালে আউশ ধানের আবাদ লক্ষ্যমাত্রার ৫০ ভাগও ছুঁতে পারেনি। এমনকি ভাদ্রের পূর্ণিমায় ভর করে প্রবল বর্ষণে আগষ্ট মাসে ৬২% বেশী বৃষ্টিপাতে উঠতি আউশ আরেক দফা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেপ্টেম্বর মাসেও স্বাভাবিকের প্রায় ৫২% বেশী বৃষ্টি হয়েছে। চলতি মাসে স্বাভাবিক ১৮৬ মিলিমিটারের স্থলে আবহাওয়া বিভাগ ১৭০ থেকে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিয়ে রাখলেও মাসের প্রথম ১৮ দিনে সে স্তর অতিক্রম করায় পরিবেশ ও ফসলের ক্ষেত্রে মিশ্র পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। অকাল অতিবর্ষণে ইতোমধ্যে মাঠে থাকা গ্রীষ্মকালীন সবজির প্রায় পুরোটা বিনষ্টের পাশাপাশি আগাম শীতকালীন সবজির আবাদকেও বিলম্বিত করছে শরৎ ও হেমন্তের প্রবল বর্ষণ। আসন্নপ্রায় রবি মৌসুমে বরিশাল কৃষি অঞ্চলে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে ১৬ লক্ষাধীক টন শীতকালীন সবজি উৎপাদনের লক্ষ্যে কৃষি যোদ্ধারা মাঠ পর্যায়ে প্রস্তুতি শুরু করলেও হেমন্তের অকাল অতিবর্ষণে তা আবার হোচট খেল।
গত বৃহস্পতিবার বিকেল সোয়া ৪টা থেকে সোয়া ৬টার মধ্যে বরিশালে ৫৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে আবহাওয়া বিভাগ। শুক্রবার বিকেল থেকেও ঘন কালো আকাশে বরিশাল সহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের বৃষ্টি শুরু হয়। ফলে হেমন্তের কার্তিকেও বিগত দুমাসের মত বাড়তি বৃষ্টিপাতের আশংকা তৈরী হয়েছে।
