3:54 pm , October 12, 2024
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ নিরাপদ প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রজনন নির্বিঘেœর মাধ্যমে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে শনিবার মধ্যরাত থেকে দেশের উপকূলের ৭ হাজার ১৩৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ২২ দিনের জন্য সব ধরনের মাছ আহরণ পরিবহন ও বিপননে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। ফলে দক্ষিণ উপকূলের জেলে পল্লী সহ মৎস্য আড়তগুলোতে ইতোমধ্যে নিরবতা নেমে এসেছে। তবে শেষ মুহূর্তে বরিশালের পোর্ট রোডের পাইকারী ও বিভিন্ন খুচরা বাজারে শনিবার দিনভরই ইলিশের রমরমা বেচাকেনা অব্যাহত ছিল। দামও ছিল নিকট অতীতের চেয়ে বেশী। ২২ দিনের এ নিষেধাজ্ঞার সময়ে দেশের দক্ষিণ উপকূলের ৩৭টি জেলার ১৫৫টি উপজেলার ৫ লাখ ৬৬ হাজার ৫৬৫ জেলের জন্য মানবিক খাদ্য সহায়তা হিসেবে সরকার ২৫ কেজি করে সর্বমোট ১৪ হাজার ১৬৫ টন চাল বরাদ্দ করেছে। এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় মৎস্য বিভাগ অভিযান পরিচালনা করবে। এলক্ষ্যে পুলিশ ও র্যাব ছাড়াও কোস্টগার্ড এবং নৌ বাহিনী মাঠ পর্যায়ে কাজ করবে বলে জানা গেছে। এলক্ষে ইউনিয়ন পর্যায় টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। মানবিক খাদ্য সহায়তা কর্মসূচীর আওতায় বরিশালের ৩ লাখ ১৯ হাজার ৮৩০ জেলে পরিবারকেও ৭ হাজার ৯৯৫ টন চাল হেওয়া হবে বলে মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে।
সারা বিশে^র ৬০%-এরও বেশী ইলিশ এখন বাংলাদেশেই উৎপাদন হচ্ছে। যার প্রায় ৭০ ভাগ ইলিশ উৎপাদন ও সহনীয় আহরণ হচ্ছে বরিশাল অঞ্চলে। আমাদের অর্থনীতিতে জাতীয় মাছ ইলিশের একক অবদান এখন ১%-এর বেশী। আর মৎস্য খাতে অবদান প্রায় ১২.৫০%।
ইতোপূর্বে আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে-পরের ২২ দিন এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশের প্রজনন সময় কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করে মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে সময় হেরফের করা হচ্ছে। ১৩ অক্টোবর থেকে আগামী ৩ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত ইলিশ আহরণ, পরিবহন ও বিপননে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকছে।
‘হিলসা ফিসারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্লান’এর আওতায় ২০০৫ সালেই প্রথম প্রধান প্রজনন মৌসুমে ১০ দিন ইলিশের আহরণ বন্ধ রাখা হয়। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে ২০১১ সালে তা ১১ দিন এবং ২০১৫ সালে ১৫ দিন ও ২০১৬ সালে থেকে ২২ দিনে উন্নীত করা হয়েছে। ইলিশ নিয়ে নানামুখি বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশে ইলিশের উৎপাদন এক সময়ের ১.৯৮ লাখ টন থেকে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৫.৬৫ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।
ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র ও মাইগ্রেশন পথ নির্বিঘœ রাখা সহ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুত ও জীব বৈচিত্রকে সমৃদ্ধ করতে ২০১৯-এর ২৬জুন হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম ‘সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা বা মেরিন রিজার্ভ এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়।
আশ্বিনের ভরা মৌসুমে ভোলার পশ্চিম আউলিয়া পয়েন্টÑতজুমদ্দিন, মনপুরা দ্বীপ, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লতাচাপলি পয়েন্ট-এর ধলচর দ্বীপ, মৌলভীরচর দ্বীপ ও কালিরচর দ্বীপ, মায়ানী পয়েন্টÑমীরসরাই ছাড়াও কুতুবদিয়া পয়েন্ট এলাকায় মা ইলিশের অত্যাধীক প্রচুর্য থাকায় ঐসব এলাকার ৭ হাজার ১৩৪ বর্গ কিলোমিটারে আগামী ২২ দিন সবধরনের মৎস্য আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকছে ।
প্রতিদিন ¯্রােতের বিপরীতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলা অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ জীবনচক্রে স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়ান করে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, উপকূলের ৭ হাজার ১৩৪ বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্ত ভাসমান অবস্থায় ছাড়া ডিম থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা, স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে বিচরন করে খাবার খেয়ে বড় হতে থাকে। নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে ৭Ñ১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়াবার পরে জাটকা হিসেব সমুদ্রে চলে যায় পরিপক্কতা অর্জনে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২Ñ১৮ মাস অবস্থানের পরে পরিপক্ক হয়েই পূর্র্ণাঙ্গ ইলিশ হিসেবে প্রজননের লক্ষ্যে আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের ইকাসিষ্টেমে সারা বছরই ৩০% ইলিশ ডিম বহন করে। এসব ইলিশ পরিপক্ক হয়ে ডিম ছাড়ে। যে ডিমগুলো পুরুষ ইলিশ দ্বারা নিষিক্ত হয়ে থাকে, তা নতুন প্রজন্ম গঠন করে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের গবেষনায় দেখা গেছে, নজরদারী বৃদ্ধির ফলে দেশে ইলিশপোনা-জাটকা’র উৎপাদন ২০১৫ সালে ৩৯ হাজার ২৬৮ কোটি থেকে ২০১৭ সালে ৪২,২৭৪ কোটিতে উন্নীত হয়। ২০২২ সালের প্রজনন মৌসুমে দক্ষিণ উপকূল সহ সংলগ্ন অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে প্রায় ৮৪% মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। এরমধ্যে ৫২ ভাগ মা ইলিশ ২২ দিনের মূল প্রজননকালীন সময়ে এবং আরো ৩২% ডিম ছাড়ারত ছিল। যা ছিল অগের বছরের প্রজননকালের চেয়ে প্রায় ২.৪৫% বেশী।
২০১৮ সালের ৭Ñ২৮ অক্টোবর আহরণ নিষিদ্ধ থাকাকালে উপকূলের প্রজননস্থল সহ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ৪৮% মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পায়। মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর মতে প্রজননক্ষম মা ইলিশের হার ২০১৭ সালে ৭৩% থেকে ’১৮ সালে ৯৩%-এ উন্নীত হয়। পাশাপাশি এসময়ে প্রজনন সাফল্য ৮০%-উন্নীত হয়। ফলে গত বছর প্রায় ৪৩ হাজার কোটি জাটকা ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছে বলে মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট এর দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।