চিকিৎসক আজাদ হত্যা মামলা চার বছরেও রহস্যের উন্মোচন হয়নি ! চিকিৎসক আজাদ হত্যা মামলা চার বছরেও রহস্যের উন্মোচন হয়নি ! - ajkerparibartan.com
চিকিৎসক আজাদ হত্যা মামলা চার বছরেও রহস্যের উন্মোচন হয়নি !

4:05 pm , September 28, 2024

হেলাল উদ্দিন ॥ বরিশাল নগরীর মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালের লিফটের নীচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিলো বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. এম এ আজাদের (৪৭) মরদেহ। ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিলের ঘটনা এটি। এরপর ৪ বছর পরিয়ে গেছে কিন্তু আজাদের মৃত্যু রহস্য আজও জানা যায়নি। মামলার তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা কোতয়ালী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এ আর মুকুল বলেন, এটি অনেক দিন আগের ঘটনা তো মনে নেই। আমি যতদূর জানি মামলার বাদী মামলা পরিচালনা করেনি। যে কারনে মামলা হয়ত আলোর মুখ দেখেনি। তিনি আরো বলেন, আমি বদলী হবার সময় মামলা থানার ওসির কাছে হস্তান্তর করে এসেছি। এখন মামলা কোন অফিসার তদন্ত করছে নাকি মামলা চলছেই না তা বলতে পারছি না। থানার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, আমি এসেছি অল্প কয়েকদিন হলো। এই মামলার বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না। তবে মামলা নম্বর দিতে পারলে এ বিষয়ে মেট্রোপলিটন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, এটি হত্যা মামলা। বাদী মামলা পরিচালনা করুক আর নাই করুক তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব হলো চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া। আমি চেষ্টা করছি এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়ার।
২০২০ সালের ২৮ এপ্রিল নগরীর কালীবাড়ি রোডে বেসরকারি মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করা হয় চিকিৎসক আজাদের লাশ। এ ঘটনায় নিহতের ছোট ভাই ডা. শাহরিয়ার উচ্ছ্বাস অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুর রহমান মুকুলকে। ঘটনার পর থেকেই মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালের মালিক ও শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ডা. জহিরুল হক মানিক বিষয়টি দুর্ঘটনা বলে প্রচার করে আসছেন। মরদেহ উদ্ধারের পর তার কথাবার্তা অসংলগ্ন ছিল। জহুরুল হক মানিক বরিশালের প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার সঙ্গে বরিশালের বড় বড় রাজনৈতিক নেতার সখ্য রয়েছে। নেতাদের দিয়ে তিনি পুলিশের উপর প্রভাব খাটিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তার একভাই পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
নিহত ডা. এম এ আজাদের বাড়ি পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার সোহাগদল গ্রামে। তিনি মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালের সাততলার একটি ইউনিটে থাকতেন। তার স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান ঢাকার কেরানীগঞ্জে থাকেন।
এম এ আজাদের স্বজন ও কয়েকজন সহকর্মী জানান, আজাদ চাকরির কারনে বরিশাল থাকতেন। চিকিৎসক হিসেবে তার সুনাম ছিল। ভদ্র ও সদালাপী একজন মানুষ ছিলেন। কারও সঙ্গে উঁচু গলায় তিনি কথা বলতেন না। গত ২৮ এপ্রিল-২০২০ আজাদের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তখন রমজান মাস ছিল। এর আগের দিন ২৭ এপ্রিল সন্ধ্যা থেকে নিখোঁজ ছিলেন আজাদ। ইফতারের আগ মুহূর্তে আজাদের স্ত্রী ফোন দিয়েছিলেন। কিন্তু আজাদ তার (স্ত্রী) ফোন ধরেননি।
ইফতারের আগে ক্লিনিকের এক কর্মচারী ইফতার নিয়ে আজাদের কক্ষে গিয়ে সেটি তালাবদ্ধ দেখতে পান। পরে কক্ষের সামনেই ইফতারের প্যাকেট রেখে আসেন। এরপর রাত ৯টার দিকে রাতের খাবার দিতে এসে একই অবস্থা দেখেন। পরে রাতের খাবারও দরজার সামনে রেখে যান। সেহরির সময় আজাদের স্ত্রী মুঠোফোনে আবার কল দেন। তখনও ফোনে তাকে পাচ্ছিলেন না। পরে তার স্ত্রী বিষয়টি হাসপাতালের মালিক জহুরুল হক মানিককে ফোন করে জানান।
ডা. মানিক সকাল ৬টার দিকে ওই হাসপাতালের সাততলায় গিয়ে দেখেন আজাদের কক্ষটি তালাবদ্ধ। এরপর তিনি বরিশালের কোতোয়ালি থানায় ফোন করেন। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে পুলিশ গিয়ে কক্ষের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখেন মুঠোফোন বিছানার ওপর রাখা। জামা-কাপড় সবই কক্ষের ভেতরে আছে। পরে পুলিশ পুরো হাসপাতাল তল্লাশি করে। একপর্যায়ে নীচ তলায় লিফটের নীচে তার মরদেহ পাওয়া যায়। এতে ধারণা করা হচ্ছে ২৭ এপ্রিল বিকেলের পর তিনি আর কক্ষে যাননি। বিকেল থেকে রাতের মধ্যেই তাকে হত্যা করা হয়। পরে মরদেহ লিফটের নীচে ফেলে রাখা হয়।
এদিকে ২৮ এপ্রিল পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য লিফটম্যান, ওই হাসপাতালের শিফট ইনচার্জ এবং ওটি বয়সহ ৯ স্টাফকে থানায় নিয়ে যান। পরিদর্শন শেষে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছিলেন, লিফট থেকে পড়ে গিয়ে এ ঘটনা ঘটার কথা নয়। এটি স্বাভাবিক কোনো দুর্ঘটনা বলেও মনে হচ্ছে না। এছাড়া মরদেহে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ঘটনাস্থল ও বিভিন্ন আলামত দেখে তাদের কাছে প্রাথমিকভাবে দুর্ঘটনা বলে মনে হয়নি।
মামলার বাদী ও নিহতের ছোট ভাই চিকিৎসক শাহরিয়ার উচ্ছ্বাস তখন বলেছিলেন হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে প্রথম দিকে পুলিশের তৎপরতা দেখা গিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পর অজ্ঞাত ইশারায় সব কিছু থেমে যায়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জানিয়েছেন ময়নাতদন্ত রিপোর্টে এম এ আজাদের মৃত্যুর কারণ ‘দুর্ঘটনা’ উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ রয়েছে সাততলার লিফটের ফাঁকা অংশ দিয়ে নীচে পড়ে আজাদের মৃত্যু হয়েছে।
তিনি বলেন, লিফটটি সচল ছিল। ডা. আজাদ কীভাবে সচল লিফটের নীচে পড়ে গেলেন। এখন এটা বড় প্রশ্ন। পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করে দুর্ঘটনার নাটক সাজানো হচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত ওই রিপোর্টটি দেখা হয়নি।
ডা. শাহরিয়ার উচ্ছ্বাস বলেন, প্রথমত উঁচু জায়গা থেকে পড়ে গেলে মাথায় আঘাত লাগে। কিন্তু আজাদের মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিল না। দ্বিতীয়ত মৃত্যুর পরপরই পুলিশ যে ছবি তুলেছিল তাতে স্পষ্ট দেখা গেছে আজাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন আছে। এ আঘাতের চিহ্ন কোথা থেকে এলো। উঁচু জায়গা থেকে পড়লে এ ধরনের ছোট ছোট আঘাতের চিহ্ন থাকার কথা নয়। তৃতীয়ত লিফটের ফাকা অংশ দিয়ে সাততলা থেকে নীচে পড়ে মৃত্যু হয়েছে বলা হচ্ছে, এটা কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ লিফট সচল ছিল। লিফট নির্দিষ্ট তলায় না আসলে দরজা খোলা যায় না। সেভাবেই লিফট কাজ করে।
তিনি আরও বলেন, মমতা স্পেশালাইজড হাসপাতালে থাকতেন ডা. আজাদ। হয়তো সেখানকার বা কোনো ব্যক্তির এমন কিছু বিষয় টের পেয়েছিলেন যা প্রকাশ পেলে তাদের বড় ধরনের ক্ষতি হতো। সে কারণেই ডা. আজাদকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
এর পরপরই মামলার তদন্ত ও গতিপথ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT