4:09 pm , September 22, 2024
আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশাল পোর্ট রোড বাজারের ইজারা দেড় কোটি টাকার বেশি। আবার লঞ্চঘাটের ইজারা হয়েছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। গ্রামের একটি ছোট বাজারের ইজারা হয়েছে দেড় লাখ টাকা আবার ফেরীঘাট, ব্রীজ ও সেতুর ইজারা ২০ থেকে ২৫ কোটি ছাড়িয়ে। এ চিত্র শুধু বরিশালের। শুধুমাত্র বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকার ১৭টি বাজারের ১৪টির ইজারা হয়েছে এরকম কাছাকাছি দরে। এতোদিন এগুলো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দখলে থাকলেও এখন তা চলে এসেছে অন্য পক্ষের কাছে। কেউ পুরাতন ইজারাদারের সাথে চুক্তিভুক্ত হয়ে কাজ করছেন, আবার কেউ নিজেই দখল করে নিয়েছেন পুরো ইজারা প্রক্রিয়া। মাঝখানে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ গুনছেন সবখানে বাড়তি টাকা। রাজস্ব ও উপার্জন বৃদ্ধির প্রলোভনে পড়ে সরকার যেমন এটাকে সমর্থন দিচ্ছেন তেমনি রাজনৈতিক দলগুলো দিচ্ছেন বাহবা। কেননা ইজারা যতই হোক পাচ্ছে রাজনৈতিক দলের লোকেরাই।
৯০ দশকে ১৪-১৬ হাজার টাকার বাজার বা ঘাট, কিংবা ব্রীজের টোলঘর রাতারাতি কোটি টাকার ঘর অতিক্রম করেছে। এতে সরকারের রাজস্ব বেড়েছে বলে দাবী প্রশাসনের। অন্যদিকে এই দর বৃদ্ধির প্রভাবে রাতারাতি ৫ টাকার স্থানে ১৫ টাকা গুনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। যা নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই প্রশাসন বা রাজনৈতিক দলগুলোর কারোই। আবার অনেক স্থানে বাতিল করে দেয়া ব্রীজ ও খেয়াঘাটের নতুন করে ইজারা দেওয়ার অভিযোগ সড়ক বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগের বিরুদ্ধে। আর এই ইজারাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগেই আছে।
সরেজমিনে বরিশালের ইজারা পরিস্থিতি যাচাই করতে এসে উঠে এলো এমন অসংখ্য ভয়াবহ চিত্র। ৫ আগস্টে ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা বাজার মনিটরিং এ এসে বরিশালের প্রায় প্রতিটি বাজারে নির্দিষ্ট খাজনা চার্ট ঝুলিয়ে রশীদ দিয়ে খাজনা আদায়ের নির্দেশনা দিয়ে যায়। কিন্তু সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন বাজার ঘুরে কোথাও কোনো সিটি চার্ট খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রথম কয়েকদিন বাজারসহ বিভিন্ন টোলপ্লাজা ও ফেরীঘাটে সহনীয় অবস্থা বিরাজ করলেও এখন সবখানে পূর্বের আগ্রাসন ও হয়রানির চিত্র। সাধারণ মানুষের দাবী এই ইজারা প্রথা বাতিল করে সহনীয় কিছু করা হোক। বিশেষ করে ১৫/২০ বছরের বেশি বয়সের বাজার ও ব্রীজগুলো ইজারামুক্ত ঘোষণার দাবী তাদের। যদিও প্রশাসন বলছে, তাহলে স্থানীয় সরকার, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের আয়ের পথ বন্ধ হবে। এগুলো চলবে কি করে? আর সাধারণ মানুষের বক্তব্য হচ্ছে, এজন্য নিয়মিত বাসাবাড়ি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সরকারকে খাজনা বা ট্যাক্স দিচ্ছে। ইজারা প্রথা যতনা উপকার করছে, তারচেয়ে ক্ষতি করছে কয়েক গুণ বেশি। উদাহরণ হিসেবে সদর উপজেলার চাঁদপুরা ইউনিয়নের তালুকদার হাট বাজারটি ঘুরে দেখার প্রস্তাব করেন অনেকে। বলেন, ১ লাখ ৪০ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়ার পর বাজারের অংশে আশ্রায়ন প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করেছে উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তারা। এখন ব্যক্তিগত স্থানে বাজার বসে সেখানে।
এসময় রূপাতলী বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে আসা মেহেন্দিগঞ্জের গাড়িচালক আলী ও তার যাত্রীরা জানান, ঝালকাঠির কাঠালিয়া সেতুটি টোলমুক্ত ছিলো বিগত সরকারের সময়ও। এখন সেখানে হঠাৎ করে টোলঘর নির্মাণ হয়েছে। এই মাত্র ১২০ টাকা টোল দিয়ে এলাম। আবার পথে মীরগঞ্জ ফেরীতে যানবাহন পারাপারের রশীদ দেওয়া হচ্ছে রিজার্ভ রশীদ। প্রতিবাদ করলে মারমুখী আচরণ করছে ইজারাদারের লোকজন।
এদিকে সরেজমিন বরিশাল নগরীর বাংলা বাজার, নতুন বাজার, চৌমাথা বাজার ও পোর্ট রোড বাজারে ঘুরে জানা যায়, খোকন সেরনিয়াবাত মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরে দৈনিক ৩শ টাকা চাঁদা দিতে হতো মুরগি ব্যবসায়ীদের। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে দৈনিক ১৫০ টাকা করে চাঁদা দিচ্ছেন তারা। এ ছাড়া সবজির দোকান থেকে ১০০, মাংসের দোকান থেকে ৭০, ডিম-পান ও ফলের দোকান থেকে ৫০ টাকা করে দিতে হচ্ছে চাঁদা। অন্যদিকে খোকন সেরনিয়াবাত মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরে মাছ ব্যবসায়ীদের দৈনিক চাঁদা দিতে হতো শতকরা ৫ টাকা। কিন্তু সরকার পতনের পর তাদের শতকরা ৩ টাকা করে চাঁদা দিতে হচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তবে এই চাঁদা তাদের কাছে ইজারা বা খাজনা নামেই তোলা হয়। বরিশাল সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে ১৭টি হাট-বাজার রয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি হাট-বাজারের ইজারা রয়েছে। সরকার পতনের পর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থী ও জনতা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বৈঠক করে নগরীর নতুন বাজার, বাংলা বাজার ও সাগরদি বাজার ইজারামুক্ত করেন। ফলে এই তিন বাজারের ব্যবসায়ীদের কোনো ইজারা দিতে হয় না এখন। তারপরও বাজার তিনটিতে পোর্ট রোড বাজারের তুলনায় সব পণ্যের দাম বেশি রাখা হয় বলে একাধিক অভিযোগ ক্রেতাদের।
যেসব বাজারের ইজারা এখনো চলমান রয়েছে তারমধ্যে চৌমাথা ও পোর্ট রোড অন্যতম।
এ দুটি বাজারে কোথাও কোনো ইজারাকৃত মূল্য তালিকার সিটি চার্ট দেখা যায়নি। ফলে নিজেদের ইচ্ছেমতো মূল্য নিচ্ছেন ইজারাদাররা। প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। আর বাড়তি মূল্যের চাপ পড়ছে ক্রেতাদের ওপর। ব্যবসায়ীরা জানান, টোকেন (রশিদ) ছাড়াই খাজনা উত্তোলন করেন ইজারাদাররা। ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে এই বাজারে কোনো সিটি চার্ট নেই। ফলে যতখুশি তত টাকা নেন ইজারাদাররা। আর ব্যবসায়ীরা জানেন না, তারা খাজনা বেশি, না কম দিচ্ছেন।
মুরগি ব্যবসায়ী সৈকত মির্জা বলেন, চৌমাথা বাজার জমে ওঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত সিটি চার্ট দেখিনি। ফলে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন ইজারাদাররা। পোর্ট রোড বাজারের ব্যবসায়ী সালাম বলেন, ২৫ থেকে ৩০ বছর ধরে ব্যবসা করছি। কিন্তু কখনো সিটি চার্ট দেখানো হয়নি আমাদের। যেটি প্রতিটি বাজারে সিটি করপোরেশনের লোকদের টানিয়ে দেওয়ার কথা।পোর্ট রোড বাজারের সবজি বিক্রেতা জয়নাল, মাছ ব্যবসায়ী জহির ও আলমাস বলেন, খোকন সেরনিয়াবাত মেয়র থাকাকালে দৈনিক যে টাকা খাজনা নিত, এখন সবক্ষেত্রে তা কিছু কম নিচ্ছে। এখানের ব্যবসায়ীরা বলেন, পোর্ট রোড বাজার তিনভাগে বিভক্ত। একাংশ বিআইডব্লিউটি এর বাকী দুই অংশ সিটি করপোরেশনের। ২০০৯ সালের এটি যখন প্রথম ইজারা হয় তখন মাত্র ৮/১০ হাজার টাকায় দরপত্র হয়। এরপর ইজারাদারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থেকে প্রতিবছরই ইজারার মূল্য বাড়তে থাকে। সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণ তাই রাগ করে সব ইজারা বাতিল বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এমনকি সিটি করপোরেশনের বাইরের তালতলী ও মিরগঞ্জ খেয়াঘাটের ইজারাও তুলে নেওয়ার প্রস্তাব ছিলো তার।
মেয়র হিরণ মারা যাওয়ার পরপরই চরকাউয়া খেয়াঘাট ছাড়া সব আবার ইজারা দেওয়া হয়েছে বলে জানালেন তারা।
মাছ ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা আরো জানান, সরকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ছিলো সেটিকে ষড়যন্ত্র করে বন্ধ করা হয়েছে। সেটি চলমান থাকলে এখনকার এই ইজারাদারদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হয়ে যেত। ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা এই বাজারের ইজারা হয়েছে। খান হাবীবের স্ত্রীর নামে এখন এই বাজারের ইজারা চলছে। বিএনপি ও খান হাবীবের লোকেরা মিলেমিশে এই বাজার চালাচ্ছে বলে জানান তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৮৫-৮৬ সালে বরিশালের বান্দরোডে কীর্তনখোলা নদীর তীরে ১ দশমিক ২৩ একর জমিতে মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) কেন্দ্রটি নির্মাণ করে। কিন্তু তখন প্রভাবশালীদের জন্য সেটি চালু করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কেন্দ্রটি চালু হয়। ওই সময় ব্যবসায়ীদের নিয়মিত মাছ বেচাকেনার ফলে কেন্দ্রটি জমজমাটও হয়ে ওঠে এবং দুই বছরে গড়ে প্রায় তিন কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ২০০৯ সালের ১৩ জুলাই ব্যবসায়ীরা পোর্ট রোডের বেসরকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে ফিরে আসে এবং সেখানেই চলছে এখন মাছ বেঁচাকেনার কাজ।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০১০ সালের দিকে এর নিয়ন্ত্রণ নেন মৎস্যজীবী লীগের নেতা খান হাবিব। তিনি ছিলেন তৎকালীন সিটি মেয়র প্রয়াত শওকত হোসেন হিরণের অনুসারী। তিনি তাঁর বাহিনী দিয়ে মোকামের পাশাপাশি রাস্তার ওপর বাজার বসিয়ে চাঁদা তুলতেন। ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মোকাম নিয়ন্ত্রণ করেছেন মহানগর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক নিরব হোসেন টুটুল। ২০২৩ সালে সাদিক আব্দুল্লাহ নগরীর আধিপত্য হারালে মোকাম আবারও খান হাবিবের নিয়ন্ত্রণে যায়। তিনি চলতি অর্থবছরে তাঁর স্ত্রীর নামে এটি ইজারা নেন। গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর খান হাবিব আত্মগোপন করেন।
পোর্টরোড নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে রয়েছেন মৎস্যজীবী দলের মহানগর সাধারণ সম্পাদক কামাল সিকদার, ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সদস্যসচিব আনিচুর রহমান মিলন ও ওয়ার্ড শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক খান মো. কামাল। খান কামাল আবার খান হাবিবের আপন ভাই। এ ছাড়া সদর উপজেলা মৎস্য আড়তদার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হয়েছেন ব্যবসায়ী জহির সিকদার। তিনি জানিয়েছেন, খান হাবীবের স্ত্রী খালেদা খানমের নামেই রয়েছে এখানকার ইজারা। তবে সিটি চার্ট টানানো হয়েছে কিনা তা তার জানা নেই বলে জানান তিনি।
বরিশাল নগরীর একটি বাজারেও সিটি চার্ট না থাকার কথা স্বীকার করে বরিশালে সিটি করপোরেশনের বাজার ও স্টল শাখার তত্ত্বাবধায়ক মু. নুরুল ইসলাম বলেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়া আমরা কোনো বক্তব্য দিতে পারি না। তবে শিক্ষার্থীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাগরদী বাজার, বাংলা বাজার ও নতুন বাজার ইজারামুক্ত রয়েছে।
অন্যদিকে পোর্ট রোড বাজারটির ইজারাদাতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) হলেও এর বেশিরভাগ অংশ অর্থ্যাৎ দুটি অংশের দায়ভার সিটি করপোরেশনের জানিয়ে বরিশাল বিআইডব্লিউটিএর উপ পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক ছোট লঞ্চঘাট ইজারা নিয়ে বলেন, গত ২৭ জুন এই ঘাটের দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে হাসিবুল এন্টারপ্রাইজ নামে প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ১ কোটি ২০ লাখ টাকায় দরদাতা হিসেবে ইজারা পায়। অপরদিকে সদ্য সাবেক ইজারাদার আবুল হোসেন অরুণ এন্টারপ্রাইজ ৭৩ লাখ টাকায় সর্বনি¤œ দরদাতা ছিলেন। তিনি বলেন, ইজারাদারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রভাব বিস্তারের ফলে টেন্ডার মূল্য বৃদ্ধি পায় এটা সত্যি। তবে এতে করে সরকার লাভবান হচ্ছে। সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী টেন্ডার হয়। অর্ধেকের বেশি দরপত্র অনুযায়ী মূল্য অগ্রীম প্রদান করতে হয়। বাকীটা প্রদানের জন্য তিন কিস্তি সুযোগ দেওয়া হয়। চলমান রাজনৈতিক পটপরিবর্তন মাথায় রেখে তাই সব ইজারাদারদের সতর্ক নোটিশ প্রদান করা হয়েছে বলে জানান বিআইডাব্লিউটি এর এই কর্মকর্তা।