3:48 pm , September 11, 2024
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশাল কৃষি অঞ্চলে পাটের আবাদ ও উৎপাদন গত বছরের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে পড়ায় কৃষি অর্থনীতিতে বিরুপ প্রভাবের আশংকা তৈরী হতে যাচ্ছ। তবে চলতি মৌসুমে এ অঞ্চলে পাটের ভালদাম পাওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। গতবছর লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে আবাদ ও উৎপাদন হলেও মূল মৌসুমে আকষ্মিক দরপতনে পাটচাষীরা মরাত্মক বিপর্যয়ের শিকার হন। এরই রেশ ধরে এবার আবাদ কিছুটা কম হওয়ার পাশাপাশি মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টির অভাবে কৃষকের আগ্রহেও কিছুটা ভাটা পড়ে। গত বছর প্রায় আড়াই লাখ হেক্টরের স্থলে চলতি মৌসুমে বরিশাল অঞ্চলে পাটের আবাদ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর কম জমিতে।
ফলে এবার বরিশালের কৃষি অর্থনীতিকে পাট নিয়ে কিছুটা বিরুপ পরিস্থিতি আশংকা থাকলেও ভাল দাম পাওয়ায় কৃষকরা বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলে আশাবাদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-ডিএই’র দায়িত্বশীল মহল। বুধবার বরিশাল অঞ্চলে প্রতিমণ কাঁচা পাট ২৮শ থেকে ৩২শ টাকা দরে বিক্রী হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ২শ থেকে ৫শ টাকা পর্যন্ত বেশী বলে জানা গেছে। বুধবার পর্যন্ত বরিশাল কৃষি অঞ্চলে ৯৯ ভাগ পাট কর্তন সম্পন্ন হয়েছে বলে ডিএই সূত্রে জানা গেছে।
২০২০ সালে পশ্চিম জোনের সবগুলো সরকারি পাটকল বন্ধ করে দেয়ার পরে পাটের বাজার আর স্থিতিশীল হয়নি। সরকারি-বেসরকারী অংশিদারিত্ব-পিপিপি পদ্ধতিতে বন্ধ পাটকল চালুর অনেক আশার বাণী বিগত সরকার শোনালেও গত ৪ বছরে দুটি পাটকল বেসরকারী খাতে চালুর পর্যায় রয়েছে। এর বাইরে বরিশাল অঞ্চলে যে ২০টির মত ছোট ও মাঝারী বেসরকারী পাটকল রয়েছে তারও প্রায় অর্ধেক বন্ধ। বেসকারী পাটকলগুলোর বেশীর ভাগই বন্ধ পুরনো মেশিনারী সহ পুজির অভাব সহ ব্যাংকের দেনায়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-ডিএই’র মতে দেশে ৮ লাখ হেক্টরের কিছু বেশী জমিতে পাট আবাদ হলেও তার প্রায় ৩০% হচ্ছে বরিশাল অঞ্চলে। তবে এবারো প্রতি মণ পাট উৎপাদন ব্যয় প্রায় আড়াই হাজার টাকা হলেও সাড়ে ৪ মাসের সাধনার এ কৃষিপণ্য আবাদ ও উৎপাদন থেকে বিক্রী পর্যন্ত মুনাফা তুলে আনা কষ্টসাধ্য। তবে এবারো পাট আবাদের মূল সময়টিতে বৃষ্টির অভাব বড় অন্তরায় সৃষ্টি করে। মূলত চলতি বছরে শুধুমাত্র মে মাস বাদে জুলাই পর্যন্ত সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে বৃষ্টির অভাবে পাট আবাদ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। এমনকি মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’এ ভর করে স্বাভাবিকের ৫০ভাগ বেশী বৃষ্টি হলেও জুনে ৬০ ভাগ ও জুলাই মাসে ৩১% কম বৃষ্টিপাতে পাট উৎপাদনে সংকট সৃষ্টি হয়। ফলে এবার পাটের গাছের বর্ধন সহ তা স্বভাবিকের কম পুষ্ট হয়েছে। এতে করে মোট উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। তবে পাট জাগ দেয়ার মূল সময়, আগষ্টে এবার স্বাভাবিকের প্রায় ৬২ ভাগ বেশী বৃষ্টি হওয়ায় গত বছরের মত পাট জাগ দেয়া নিয়ে বরিশাল অঞ্চলে কোন সংকট সৃষ্টি হয়নি।
এদিকে পাট গবেষনা ইনষ্টিটিউট ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের পরিবেশ উপযোগী নোনা পানি সহনীয় পাটের উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। ইনষ্টিটিউট আমদানীকৃত বীজের চেয়ে উন্নতমানের ও উচ্চ ফলনশীল নাবী জাতের পাটবীজ উদ্ভাবন করেছে। আগামীতে এ পাট বীজই দেশের সব আবাদকৃত এলাকার চাহিদা মেটাবে বলেও পাট গবেষনা ইনষ্টিটিউট-এর দায়িত্বশীল মহল আশাবাদী। মাঠ পর্যায়ে কৃষকের কাছে সে বীজ ও আবাদ প্রযুক্তি পৌঁছে দিতে ডিএই’র বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করছেন কৃষিবীদরা।
দানাদার খাদ্য ফসলের পরে পাটই বরিশাল অঞ্চলে কৃষি অর্থনীতির বড় যোগানদার হয়ে উঠেলেও এ অঞ্চলে কোন সরকারি পাটকল নেই। বেসরকারী খাতের ছোট-বড় ২৪টি পাটকলেরও দুই-তৃতীয়াংশই বন্ধ। বন্ধ বেশীরভাগ পাটকল ভবিষ্যতে চালুরও কোন সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। অথচ বেসরকারী খাতে দেশের অন্যতম বৃহত্তর করিম জুট মিল ছাড়াও পারটেক্স গ্রুপ ও আকিজ গ্রুপের পাটকলগুলো এ অঞ্চলেই। তবে দেশের বিভিন্ন এলাকার বেসরকারী পাটকলগুলো এ অঞ্চলের মোকামগুলো থেকে সীমিত কিছু পাট কিনলেও তাদের ফড়িয়াদের বেঁধে দেয়া দরের ওপরই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে পাট চাষীদের।
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসেবে দেশে পাটচাষির সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ হলেও এখাতের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। আর জিডিপি’তে পাটের অবদান ০.২৬% হলেও কৃষি সেক্টরে একক অবদান ১.১৪%। দেশে উৎপাদিত পাটের ৫১% এখনো স্থানীয় পাটকলে ব্যবহৃত হলেও ৪৪% কাঁচা পাট রপ্তানি হচ্ছে। আর বরিশাল কৃষি অঞ্চলে দেশের ৩০% পাট আবাদ উৎপাদন হচ্ছে।
পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে দেশ প্রতিবছর আয় করছে প্রায় ৯০ থেকে ১শ কোটি ডলার। এ আয়ের সিংহভাগই এসেছে পাটসুতা বা জুট ইয়ার্ন থেকে। কাঁচাপাট রপ্তানিতে আয় ১ কোটি ডলার। পাটের বস্তা ও চট রপ্তানি করেও আয় হচ্ছে ১০ কোটি ডলারের মত। এছাড়া বিভিন্ন পাটজাত পণ্য রপ্তানিতেও আয় প্রায় ২০ কোটি ডালারের মত। তবে গত কয়েক বছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানীতে তেমন কোন প্রবৃদ্ধি ছিল না।
অপদিকে পাটখড়ির ছাই ‘চারকল’ চীন সহ বিশে^র কয়েকটি দেশে ভাল বাজার তৈরী করেছে ইতোমধ্যে। প্রতি বছর বিশে^র বিভিন্ন দেশে প্রায় ৩০ কোটি ডলারের চারকল রপ্তানি হচ্ছে বলে জানা গেছে।