4:06 pm , September 10, 2024
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশাল মহানগরীর ‘প্রকৃতির হৃদস্পন্দন’ খ্যাত ‘বেলস পার্কটির সর্বনাশ ঠেকাতে অবিলম্বে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন নগরবাসী। গত কয়েক বছর ধরে কর্তৃপক্ষের বিবেকহীন উদাসীনতা ও অবহেলায় নানাভাবে বিশাল এ উদ্যানটির সর্বনাশ অব্যাহত রয়েছে। অথচ ইতোপূর্বে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে এ উদ্যানটির চারিধারে ওয়াকওয়ে সহ দৃষ্টিনন্দন বৃক্ষ রোপন সহ রাতের লাইটিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুরো নগরবাসী প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বেলস পার্কে শ্রান্তি বিনোদন সহ হাটার জন্য আসতেন। দিনরাত অত্যন্ত নির্ভরতার সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াতেন নারী ও শিশু সহ সব বয়সী মানুষ। কিন্তু ক্রমে এখানে আড্ডাবাজ সহ বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীদের অনৈতিক ভ্রমন সহ নানা অনুষ্ঠান ও মেলার নামে প্রকৃতির দানকে গলা টিপে মারা হচ্ছে। পরিবেশকে বিপন্ন করার সাথে ধীরে ধীরে পার্কটির উত্তর প্রান্ত থেকে ময়দানের অভ্যন্তরে পথ খাবারের দোকান সহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাবা বসাতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে পার্কটির পুরো উত্তর পাশের রাস্তা সহ সবকটি প্রবেশদ্বার দখলের পরে মাঠের অভ্যন্তরেও বিপুল সংখ্যক দোকানপাট বসতে শুরু করেছে। ফলে ঐতিহ্যবাহীবেলস পার্কটির মূল চরিত্র হারিয়ে গেছে অনেক আগেই।
অথচ ১৯৬৬ সালে বরিশাল স্টেডিয়াম নির্মানের আগ পর্যন্ত এই বেলস পার্কেই তৎকালীন বৃহত্তর বাকেরগঞ্জ জেলার ফুটবল লীগ সহ সব ধরনের খেলাধুলার পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হত। এখনও প্রতিবছর মহান স্বাধিনতা ও বিজয় দিবসে সম্মিলিত কুচকাওয়াজ বেলস পর্কেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
কিন্তু নানা ধরনের অনুষ্ঠান ও মেলার নামে পার্কটির মূল চরিত্র হারিয়ে গেছে। ভয়াবহ ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে মূল মাঠে। বিশেষ করে গত কয়েক বছর ধরে বেলস পার্কের উত্তরাংশজুড়ে বৃক্ষমেলা আয়োজনের নামে মাঠটিতে অপরিকল্পিতভাবে বালু ফেলে উঁচু করা হচ্ছে। ফলে ইতোমধ্যে উত্তর পাশের ওয়াকওয়ের চেয়ে মাঠ উঁচু হয়ে গেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই বেলস পার্কের উত্তরাংশের দুটি ওয়াকওয়েই ডুবে যাচ্ছে। এমনকি ওয়াকওয়ের উত্তর পাশে যে চলাচলের মূল সড়ক রয়েছে সেটিও সামান্য বৃষ্টিতে নিমজ্জিত হয়ে চলাচলে বিপত্তি ঘটাচ্ছে। নগরবাসী সহ পরিবেশবীদরা ঐতিহ্যবাহী বেলস পার্কে কুচকাওয়াজ, খেলাধুলা এবং ক্রীড়া প্রতিযোগীতা ছাড়া সব ধরেনের মেলা ও অনুষ্ঠান বন্ধ সহ পথ খাবারের দোকানগুলো অবিলম্বে অপসারণের দাবী জানান হয়েছে।
বৃটিশ যুগে বর্তমান বরিশাল এবং তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার জেলা ম্যজিস্ট্রেট ‘মিঃ বেল’ বগুড়া-আলেকান্দা মৌজার চাঁদমারী এলাকার প্রায় ৯ একর জমির ওপর একটি মুক্ত উদ্যান ও তার দু’দিক ঘিরে একটি লেক খনন করে। তখন তার নাম অনুসারেই উদ্যানটির নামকরন হয় ‘বেলস পার্ক’। তবে গণপূর্ত অধিদপ্তর এ পার্কটির মালিকানা সহ তার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব লাভ করলেও বছর কয়েক আগে উদ্যানটির দুই দিকে জেলা প্রশাসন থেকে নকশা খচিত বিশাল প্রস্তর খন্ডে ভূমির মালিক ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ ময়দানের উন্নয়ন ও রক্ষনাবেক্ষনে জেলা প্রশাসনের কোন ভূমিকা নেই।
১৯৭৩ সালের ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বরিশাল সফরকালে একটি সুন্দর নান্দনিক উদ্যান গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘বঙ্গবন্ধু উদ্যান’র ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। তার জনসভার জন্যই উদ্যানটির উত্তর পাশে একটি স্থায়ী মঞ্চও নির্মিত হয় তখন। সে থেকে বেলস পার্কের সাথে এ উদ্যানটি বঙ্গবন্ধু উদ্যান নামেও পরিচিত লাভ করে। তবে ২০০৪ সালের আগে উন্নয়নের কোন ছোঁয়া লাগেনি। ঐতিহাসিক এ উদ্যানে ইতোপূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী, সংবিধান প্রনেতা ড. কামাল হোসেন ও এইচএম এরশাদ সহ বিভিন্ন জাতীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রেখেছেন।
২০০৪ সালে প্রথম নির্বাচিত সিটি মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ারের উদ্যোগে সরকারী প্রায় ৩ কোটি টাকায় গণপূর্ত অধিধপ্তরের মাধ্যমে উদ্যানটির চারিধারে ওয়াকওয়ে, বসার বেঞ্চি এবং ছাতা সহ শৌচাগার ও বিশ্রমাগার নির্মান ছাড়াও দৃষ্টিনন্দন বাতি লাগান হয়। পাশাপাশি শোভা বর্ধনের জন্য পুরো মাঠের ওয়াকওয়ের মাঝে এবং চারিধারে গাছও লাগান হয়েছিল। সেই থেকে উদ্যানটির পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন। প্রতিদিনই নগরীর বিপুল সংখ্যক মানুষ এ উদ্যানে সকাল-বিকেল হাটতে ও শ্রান্তি বিনোদনে আসা শুরু করেন। তবে ১/১১ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর অজ্ঞাত কারণে এখান থেকে সব ‘গার্ডেন লাইট’ খুলে নেয়ায় ভূতুড়ে পরিবেশ ও নিরাপত্তার অভাবে সান্ধ্য ভ্রমণকারীরা এ উদ্যান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন।
২০১১ সালে তৎকালীন সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরণ তহবিল সংগ্রহ করে গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে উদ্যানটিতে দ্বিতীয় ওয়াকওয়ে নির্মান সহ পূর্ব পাশের্^ বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপন করেন। পাশাপাশি উদ্যানটির পূর্বপাশের নালাটি সংস্কার করে সেখানে শাপলার আবাদ ছাড়াও সংলগ্ন বাঁধ রোডে পাকা ফুটপাথ নির্মান ও পাশে সোনালু গাছ লাগান হয়। যা এখনো নগরবাসীর চোখ জুড়ায়।
দ্বিতীয় দফায় সংস্কারের পরে উদ্যানটিতে প্রাত ও বৈকালিন ভ্রমণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি আড্ডাবাজদের ভীড় বেড়েছে। বর্তমানে উদ্যানটির পুরো এলাকা কিশোর গ্যাং-এর দখলে থাকছে। বেলপার্ক জুড়ে ইতোমধ্যে নানা ধরনের পথ খাবারের দোকান আড্ডাবাজদের জন্য বাড়তি সুবিধা সৃষ্টি করেছে। এ উদ্যানে কিশোর গ্যাং-এর হামলায় সম্প্রতি এক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী পর্যন্ত শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন।