3:47 pm , August 31, 2024
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ এ যেন ভাসমান দোকান বসানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে নগরীর দর্শনীয় ও বিনোদন স্থানগুলোতে। যে যেভাবে পারছে দখল করে নিচ্ছে বিনোদন স্থানগুলোর আশেপাশের ফাঁকা জায়গা। গড়ে তুলছে রকমারি খাবারের দোকান কিংবা মনোহারি বাণিজ্যিক পসরা। কেউ দোকান তুলে ভাড়া দিচ্ছে, কেউ আবার নিজেই ব্যবসা করছেন। পাশাপাশি এসব দোকানে নির্দ্বিধায় ব্যবহার হচ্ছে অবৈধ বিদ্যুৎ। যা নিয়ে ওজোপাডিকোর নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক হোসেন অবৈধ ভাসমান দোকানদারদের পক্ষ নেন। গত ১০ বছর ধরে অবৈধ বিদ্যুতের সাহায্যে এসব দোকান সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অবধি চললেও বিদ্যুৎ বিভাগ ছিলো সম্পূর্ণ নিশ্চুপ।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে নগরীতে এসেছে তুমুল পরিবর্তন। বরিশালের স্বাধীনতা পার্ক, চৌমাথা, বেলস পার্ক ও কাঞ্চন পার্ককে ঘীরে গড়ে উঠেছে এসব ভাসমান দোকান। আগের রাজনৈতিক প্রভাব ও চাঁদাবাজি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন উম্মুক্ত এসব জায়গার নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছেন একশ্রেণির স্থানীয় টোকাই যুবকরা। এদের কারো রাজনৈতিক পরিচয় আছে আবার কারো নেই। কেউ কিশোর গ্যাং আবার কেউ যুব গ্যাং লিডার হয়ে নগরজুড়ে চালাচ্ছেন দাপট।
সরেজমিনে ৩১ আগস্ট বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১৩ নং ওয়ার্ড স্বাধীনতা পার্ক এবং ২১ ও ২২ নং ওয়ার্ডের চৌমাথা লেক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এই চিত্র। রাতারাতি গজিয়ে ওঠা ভাসমান দোকানগুলোর বেশিরভাগ মালিকই স্থানীয় টোকাই তরুণ-যুবক। যা তৈরি করে ভাড়া দেয়া হয়েছে। আবার কয়েকটি দোকানের মালিক নিজেই আশেপাশের বস্তির বাসিন্দা। চা, ফুচকা, চটপটি, হালিম, ঝালমুড়ি, মেয়েদের অলংকার ইত্যাদি নানা রকম বাণিজ্যিক পসরা এই দর্শনীয় এলাকা পুরোপুরি ঘীরে ফেলেছে। যে কারণে দৃষ্টি সীমানার আড়ালে চলে গেছে চৌমাথা লেক ও স্বাধীনতা পার্কের সৌন্দর্য্য।
বরিশাল নগরীর সৌন্দর্য্যরে অন্যতম একটি স্থাপনা চৌমাথা লেক। মহাসড়ক ধরে আসা-যাওয়া যাত্রী ও পথচারীদের চোখের শান্তি এবং বিশ্রামের স্থান এটি। অথচ দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর দখলদারিত্বের শিকার এই লেকটি। এটি পুনরুদ্ধার ও সংস্কারের দাবী স্থানীয় বাসিন্দাসহ নগর চিন্তাবিদদের। যদিও ভাসমান খাবারের দোকানগুলোর কারণে এটি পুনরুদ্ধার ও সংস্কার খুবই কঠিন কাজ বলে মনে করেন নগরবাসী। তাদের অভিযোগ, এসব দোকানগুলোতে সন্ধ্যা হলেই আলোকোজ্জ্বল করা হয়। প্রতিটি দোকানে রয়েছে তিন-চারটি উঁচু পাওয়ারের বাল্ব। এই সংযোগ কি বিদ্যুৎ বিভাগের জন্য ক্ষতিকর নয়?
নগর চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাজী মিজানুর রহমান বলেন, এগুলো নিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছে হয়না। বরিশালের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী এরকম অনেক সৌন্দর্য্য এবং স্থাপনা নষ্ট হয়ে পড়ে আছে দীর্ঘদিন। চৌমাথা লেক, স্বাধীনতা পার্ক, মুক্তিযোদ্ধা পার্ক, বেলস পার্ক সবগুলো জনগণের বিনোদন স্থানে কি এখন আর কোনো জনগণ যাতায়াত করতে পারে? সব এখন হকার আর বখাটেদের দখলে। তিনি বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রশাসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী দর্শনীয় ও বিনোদন স্থানগুলো দ্রুত সংস্কার ও সংরক্ষণ করুন। বিশেষ করে বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘর ও দর্শনীয় স্থানগুলো নিরাপদ রাখা, পর্যটকদের সুবিধা নিশ্চিত করা খুবই জরুরী বলে জানান তিনি।
বিগত ১৫ বছরে বরিশালের চৌমাথা লেকের পাড়ে গড়ে উঠেছে শতাধিক পথ খাবারের দোকান। আর এ কারণে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বরিশাল মহানগরীর সৌন্দর্য্য বর্ধনকৃত ‘নবগ্রাম রোড-চৌমাথা লেকটি ইতোপূর্বে নগরবাসীর গলার কাটা হয়ে উঠেছিল। তবে ওইসব অবৈধ স্থাপনার দখল কায়েমের পেছনে সাবেক নগর পরিষদের দু/একজন কাউন্সিলরের ভূমিকা ছিলো বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। এসব অবৈধ দোকানের কারণে দেশের ৮ নম্বর জাতীয় মহাসড়কটির এ অংশে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। লেকটির উত্তর প্রান্তে সড়ক অধিদপ্তরের জমি দখল করে জাতীয় মহাসড়কের ওপর নির্মিত শিশুপার্কটিও ইতোমধ্যে নগরীর অন্যতম দুর্ঘটনাস্থলে পরিনত হয়েছে। বিগত নগর পরিষদগুলোর বিবেকহীন এ কর্মকান্ড নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন সচেতন নাগরিক সমাজ। এমনকি এ পার্ক নির্মানের নামে সিটি করপোরেশনেরই ‘রাজকুমার ঘোষ রোডটির সাথে মহাসড়কের সংযোগ স্থলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে এখানে অন্তত ৩শ পরিবার সহ দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকদের চলাচলের সহজ পথ বন্ধ করেছে সিটি করপোরেশন। এ পার্কটির বিষয়ে সড়ক অধিদপ্তর ও নগর ভবনের মধ্যে এখন ঠেলাঠেলি শুরু হলেও প্রকৃত কোন সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। লেকটির পাড় থেকে অবৈধ পথ খাবারের দোকানপাট উচ্ছেদের পরে তা পুনর্বহালে স্থানীয় এলাকাবাসী, মুসল্লী সহ ঐ মহাসড়ক ব্যবহারকারী এবং নগরীর বেশীরভাগ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, নবগ্রাম রোডের চৌমাথা সংলগ্ন এই লেকটিকে ঘীরে প্রতিদিন হাজারো নারী পুরুষ ও শিশুদের আনাগোনা। কিন্তু লেকের পাড়ে একটু স্বস্তিতে বসার সুযোগ কারো নেই। পুরো লেক পাড় দখল করে হকারদের পসরা। একটু আধটু জায়গা যাও ফাঁকা আছে, তাও এই ভাসমান দোকান মালিকদের আড্ডাখানা। অর্থাৎ বেশিরভাগ দোকানতো লোক রেখে চালায় স্থানীয় তরুণদের একটা অংশ। কর্মচারী দোকান চালায় আর পাশে লেক পাড়ে ঐ তরুণদের আড্ডা চলে। কোনো কাস্টমারের সাথে ঝগড়াবিবাদ দেখা দিলেই এরা হামলে পড়ে বলে জানান তারা।
বিষয়টি সিটি করপোরেশনের আওতায়। তাই এ নিয়ে নিরব বরিশালের পুলিশ প্রশাসন। বলেন, কোনো অভিযোগ না পেলে আমাদের করণীয় কিছু নেই। আর পার্কের আশেপাশে ভাসমান দোকান থাকবে কি থাকবে না এটা সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রশাসক বরিশালের বিভাগীয় কমিশনার শওকত আলী বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে খুব শীঘ্রই একটা পদক্ষেপ নেব। সুশীল সমাজের কেউ যদি আলোচনা ও পরামর্শ নিয়ে আসেন, তাহলে তাকে স্বাগতম। তখন তারা যা পরামর্শ দেবেন সেটাই হবে আমাদের পদক্ষেপ। এ দায়িত্ব আপনারা সাংবাদিক সমাজও করতে পারেন। পরষ্পরের সহযোগিতা নিয়েই সুন্দর ও নিরাপদ বরিশাল গড়তে হবে বলে জানান প্রশাসক।