4:26 pm , July 7, 2024

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আজ (সোমবার) থেকে চীন সফরকালে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে ভাঙ্গা-বরিশাল-পায়রা রেল সংযোগ প্রকল্পটি নিয়েও আলোচনার উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে চীনা প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে। যার মধ্যে ভাঙ্গা-বরিশাল-পায়রা রেল সংযোগ প্রকল্পটি সহ রেলওয়ের ৬টি প্রকল্প রয়েছে। এলক্ষ্যে রেলওয়ে থেকে ইতোমধ্যেই সব ধরনের তথ্য উপাত্ত সম্বলিত একটি পরিপূর্ণ রূপরেখা রেল মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠান হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রায় ৪১ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ এ প্রকল্পটির বিষয়ে রেলওয়ের দায়িত্বশীল সূত্র আশাবাদী। চীনা রাষ্ট্রদূত ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে একটি ধারনা লাভের লক্ষ্যে বরিশাল সফল করে গেছেন।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বরিশাল বিভাগীয় সদর ছাড়াও দক্ষিণের ৪টি জেলা এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর সহ কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র রেল সংযোগের আওতায় আসবে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও এ প্রকল্পটির বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী। তার আগ্রহেই ইতোমধ্যে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, পথ নকশা সহ বিস্তারিত নকশা প্রনয়ন সম্পন্ন হয়েছে। চীনা ঋণেই ইতোমধ্যে ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা এবং ভাঙ্গা-যশোর রেলপথের নির্মান কাজ শেষ হয়েছে।
বৃটিশ যুগ থেকে দেশের পাঠ্যবইতে প্রশ্ন ছিল, ‘রেল লাইন নেই কোন জেলায়’ ? উত্তর ছিল ‘বরিশাল জেলায়’ ! সেই বরিশালই আজকের বিভাগ। তবে সে দুর্নাম ঘোচাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুঃসাহসিক প্রকল্প হিসেবে নদী-নালার বরিশাল অঞ্চলকে রেল যোগাযোগের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও নানা কারণে তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই এ লক্ষ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অন্যসব কিছুর সাথে দরপত্র দলিল প্রস্তুতও সম্পন্ন হয়েছে ২০২১ সালের জুলাইয়ে। কিন্তু ‘৪১ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষ ২১১ কিলোমিটার এ রেলপথ নির্মান প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কার্যক্রম পিছিয়ে যেতে থাকলে প্রকল্প ব্যয় বাড়বে’ বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহল। রেলপথটি নির্র্মানে যে ৫ হাজার ৬৩৮ একর ভূমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবার সাথে ওই প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধির কথাও বলেছে সংশ্লিষ্ট মহল। তবে বরিশাল অঞ্চলের ক্ষমতাসীন দলের জাতীয় পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা প্রকল্পটি নিয়ে আশা না ছাড়লেও তা নিয়ে নেতৃবৃন্দের তেমন কোন তৎপরতাও নেই। প্রকল্পটি নিয়ে যতটুকো অগ্রগতি এ পর্যন্ত হয়েছে, তার সবই প্রধানমন্ত্রীল স্ব-উদ্যোগ বলেও দায়িত্বশীল সূত্রে বলা হয়েছে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের বিবেচনা মতে পিপিপি পদ্ধতিতে ডিপিএম-এ ১টি প্যাকেজে বা ওটিএম পদ্ধতিতে ৪টি প্যাকেজে প্রকল্পটি বাস্তবায়নযোগ্য। ইতোপূর্বে ২০২৩ সালের জুলাই নাগাদ ভাঙ্গা-বরিশাল-পায়রা-কুয়াকাটা রেললাইন প্রকল্পটির বাস্তব অবকাঠামো নির্মান কাজ শুরু করে ২০২৮ সালের মধ্যে ট্রেন চালুর আশাবাদী ছিল রেলপথ বিভাগ। প্রথম ৩ বছরের মধ্যে ভাঙ্গা থেকে বরিশাল সেকশনের ৯৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মান সম্পন্ন করে ট্রেন চালু সম্ভাবনার কথাও বলেছিলো একাধিক কারিগরি বিশেষজ্ঞ।
কিন্তু পুরো বিষয়টি এতদিন অন্ধকারেই ছিল। প্রকল্পটির জন্য দাতা বা বিনিয়োগকারীর অভাবের সাথে নানা অজ্ঞাত কারণে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আগ্রহের ঘাটতি পুরো বিষয়টিকে স্থবির করে দিয়েছে বলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানিয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময়ই প্রকল্পটি নিয়ে খোঁজ খবর রাখা সহ দাতা সংগ্রহে সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দিয়ে গেছেন বলেও একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৮ সালের অক্টোবরে ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশন থেকে বরিশালÑপায়রাÑকুয়াকাটা রেলপথ নির্মানের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, বিস্তারিত নকশা প্রনয়ন ও টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরীর লক্ষ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হলেও করোনা সংকটের পাশাপাশি এলাইনমেন্ট পরিবর্তনের কারণেও বিলম্বের কথা জানিয়েছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। সরকারের সিদ্ধান্তনুযায়ী প্রস্তাবিত রেলপথের কয়েকটি স্থানে পুনরায় জরিপ পরিচালনা করে নতুন এলাইনমেন্ট অনুযায়ী নকশা প্রনয়ন করা হয়।
২১১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেলপথ নির্মানের ফলে বরিশাল বিভাগীয় সদর সহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল ছাড়াও পায়রা বন্দর ও পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা রেলপথে ভাঙ্গা জংশন হয়ে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও উত্তরবঙ্গ সহ বেনাপোল স্থল বন্দরের সাথে যুক্ত হবে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে কুয়াকাটা পর্যন্ত প্রস্তাবিত সিঙ্গেল লেন ব্রডগেজ এ রেলপথে ১১টি স্টেশনের প্রস্তাব করেছে। মূল জংশন থাকবে ফরিদপুরের ভাঙ্গাতেই। সেখান থেকে একটি লাইন পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় এবং অপর একটি লাইন ভাটিয়াপাড়াÑকালনা-নড়াইল-যশোর ও খুলনা ছাড়াও বেনাপোল এবং অপর লাইনটি ফরিদপুরÑরাজবাড়ী-কুষ্টিয়া পাকশি হয়ে উত্তরবঙ্গের সাথে যুক্ত করবে। প্রস্তাবিত বরিশাল-পায়রা-কুয়াকাটামুখী রেলপথে ভাঙ্গার পরে টেকেরহাট, মাদারীপুর, গৌরনদী, বরিশাল বিমানবন্দর, বরিশাল মহানগর, বাকেরগঞ্জ, পটুয়াখালী, আমতলী,পায়রা বিমানবন্দর, পায়রা বন্দর হয়ে সর্বশেষ কুয়াকাটাতে স্টেশন নির্মানের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বৃটিশ যুগেই ফরিদপুরÑবরিশাল রেল সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ১৮শ শতাব্দীর শেষভাগে জরিপ কার্যক্রম শুরু করে প্রায় ৫০ বছর পরে প্রতিবেদন পেশ করা হয়। কিন্তু নদীÑনালার দেশ বরিশালে রেল লাইনে বিপুল সংখ্যক সেতু ও কালভার্ট নির্মান করতে হবে বিধায় প্রকল্পটি পরিত্যক্ত হয়। দেশ বিভাগের পরে পাকিস্তান সরকার ফরিদপুরÑবরিশাল রেল যোগাযোগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বৃটিশ যুগের এলাইনমেন্ট অনুযায়ী ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করলেও মূল প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে তেমন অগ্রগতি হয়নি।
তবে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু করে ফরিদপুর প্রান্ত থেকে নির্মান কাজ শুরু করে তালমা পর্যন্ত রেলপথ নির্মান ও রেল যোগাযোগ শুরু হয়। ১৯৮২ সালে লাইন স্থাপন ও স্টেশন নির্মান সম্পন্ন করে পুকরিয়া পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার রেল যোগাযোগ চালু এবং ভাঙ্গা পর্যন্ত মাটির কাজ সম্পন্ন হয়। কিন্তু এরশাদ সরকার ক্ষমতা দখলের পরে ১৯৮৩ সালে ফরিদপুরÑবরিশাল রেল লাইন প্রকল্পটি বাতিল করে অধিগ্রহণকৃত ভূমি অবমুক্ত করার নির্দেশ দেয়। ফলে পুরো প্রকল্পটি দীর্ঘদিন অন্ধকারেই ছিল।