মৎস্য আহরণে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সুফল নিয়ে সংশয় মৎস্য আহরণে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সুফল নিয়ে সংশয় - ajkerparibartan.com
মৎস্য আহরণে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সুফল নিয়ে সংশয়

4:28 pm , July 1, 2024

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ দেশের সুনীল অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন সহ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ রক্ষায় সমুদ্র এলাকায় ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের মৎস্য আহরণ নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও পাশ^বর্তী দেশের জেলেদের চোরাগোপ্তা মৎস্য শিকার বন্ধ হয়নি। এমনকি আজ পর্যন্ত প্রতিবেশী ভারত ও মায়ানমারের সাথে অবৈধ মৎস্য শিকার বন্ধে কোন যৌথ পদক্ষেপ গ্রহণেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে বাংলাদেশের গোটা সমুদ্র এলাকায় মৎস্য আহরণে ৬৫ দিন সহ আশি^নের  পূর্ণিমার আগে পরে ইলিশের মূল প্রজননকালীন সময়ে উপকূলের ৩ হাজার ৩৪৪ বর্গ কিলোমিটারে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ভারত ও মায়ানমারের জেলেদের মাছ শিকার বন্ধ থাকছে না। অথচ মৎস্য বিজ্ঞানীরাও প্রতিবেশী দেশের সাথে সমন্বয় ও সমতা রেখেই সাগরে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধের সময় পুণঃবিবেচনার কথা বলে আসছেন।
ভারতে সর্বপ্রথমে ১৯৮৮ সালে ১৫ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সমুদ্রে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ থাকলেও ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশ সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের সাগর এলাকায় ১৫ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মিয়ানমারেও জুন থেকে আগষ্টে সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও আমাদের সমুদ্র সীমায় আহরণ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত। ফলে প্রতিবেশীদের সাথে আমাদের নিষেধাজ্ঞার পরিপূর্ণ সঙ্গতি থাকছে না। উপরন্তু প্রতিবেশী দেশসমূহে নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে পদক্ষেপ জোরাল নয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় আহরণ নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে ভারত ও মায়ানমারের জেলেরা আমাদের একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে দেশের বিশিষ্ট মৎস্য বিজ্ঞানী ও মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক(সামুদ্রিক) ড. মোঃ আবুল হাসনাত বলছেন, নির্দিষ্ট সময়ে মাছধরা বন্ধ রাখা সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের কার্যকরি ব্যবস্থাপনার একটি সহজ ও অত্যন্ত ফলদায়ক পদ্ধতি। যা বিশে^র বিভিন্ন দেশে বাস্তবায়ন হচ্ছে। জাতীসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থায় কর্মরত ড. হাসনাত সমুদ্রে আহরণ নিষেধাজ্ঞার সময়কাল প্রতিবেশী দেশের সাথে সমন্বয় করে নির্ধারনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
দেশের মৎস্য সম্পদে সামুদ্রিক মাছের অবদান প্রায় ১৫%। বঙ্গোপসাগরে আমাদের একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রায় ৫.১৬ লাখ জেলে ২৫৫টি বানিজ্যিক ট্রলার ছাড়াও প্রায় ৩৩ হাজার ইঞ্জিনচালিত ও ৩৫ হাজার ইঞ্জিনবিহীন নৌকায় নানা সরঞ্জামের সাহায্যে মৎস্য আহরণ করে থাকেন। ছোট-বড় ৪৭৫ প্রজাতির মাছ ছাড়াও ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া, ৫ প্রজাতির কচ্ছপ ও ১৩ প্রজাতির প্রবাল সহ বিভিন্ন জলজ সম্পদে সমৃদ্ধ আমাদের সমুদ্র এলাকা। সাগরে আহরিত মাছের ৪৫ ভাগ ইলিশ, ৪৯ ভাগ বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ ছাড়াও চিংড়ির পরিমান ৬ভাগ।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, সাগরে আহরণ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবার আগে  ও পরে আহরিত মাছের ক্যাচলগ পর্যালোচনায় আহরণের পরিমান বৃদ্ধির সুস্পষ্ট প্রবনতা লক্ষ্য করা গেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানেও আহরণে নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের পরের বছরগুলোতে সাগরে মাছের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে দেশে উৎপাদিত ৪৩ লাখ ৮৪ হাজার টন মাছের মধ্যে সামুদ্রিক এলাকায় উৎপাদন ছিল প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার টন। যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ লাখ টন অতিক্রম করে। সাম্প্রতিক বছরে ১ লাখ টন মাছ রপ্তানি করে  যে প্রায় ৫ হজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে, তারমধ্যে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের অবদানও ব্যাপক বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে। এমনকি সরকার বঙ্গাপসাগরে দেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক অঞ্চলে সব ধরনের বানিজ্যিক মাছধরা নৌযানে মৎস্য আহরণে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করায় গত কয়েক বছরে সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন লক্ষাধিক টন বৃদ্ধি পেয়েছে।
বঙ্গোপসাগরে আহরণ নিষিদ্ধকালীন ৬৫দিন কোন ধরনের সামুদ্রিক ট্রলার সহ মাছ ধরার নৌকার পরিচালন ও বিচরন বন্ধের বিষয়টি নিশ্চিত করণে মৎস্য অধিদপ্তর নৌ পুলিশ, কোষ্টগার্ড, র‌্যাব ও নৌ বাহিনী সহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় অভিযান পরিচালনার কথাও জানিয়েছে। নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে আহরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে সম্ভব সব কিছু করার কথা জানিয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপ পরিচালক।
কিন্তু এ নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও ভারত ও মায়ানমারের জেলেদের চোরাগোপ্তা মৎস্য শিকারের অভিযোগ করেছেন মৎস্যজীরা। বরিশাল, পাথরঘাটা, গলাচিপা, হিরণপয়েন্ট এলাকার  মৎস্যজীবীরা ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশের অভিযোগ করে তা প্রতিহত করতে না পারলে বাংলাদেশের এ কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে পড়বে বলেও দাবী করেছেন। এমনকি এ নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে মৎস্য আহরণে বিরত জেলেদের খাদ্য নিরাপত্তায় এবারো সরকার উপকূলের ৬৮ উপজেলায় ৩ লাখ ১১ হাজার ৬২ জেলে পরিবারের মধ্যে ৫৬ কেজি করে সর্বমোট ১৭ হাজার ৪১৯ টন চাল বিতরণ করেছে। এরমধ্যে বরিশাল বিভাগের ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৯টি জেলে পরিবার ৮ হাজার ১৭৭ টন খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন।
বাংলাদেশের দক্ষিন সীমানাজুড়ে বিস্তীর্ণ জলরাশির সঞ্চালন সুনীল ঢেউ-এর মাথায় যে রূপালী উর্মিমালা আলিঙ্গন করছে, বিশ্ব মানচিত্রে তা-ই বঙ্গোপসাগর। পৃথিবীর অন্য সব সাগরের মতই প্রকৃতির সব লীলার সঙ্গিনী হয়ে মেতে আছে আমাদের অবিচ্ছেদ্য বঙ্গোপসাগরও। মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, বিভিন্ন বৈশিষ্ট ও বৈচিত্রপূর্ণ মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বিশে^র একমাত্র উপসাগর যেখানে সবচেয়ে বেশী নদী বিধৌত পানি প্রবেশ করে। দক্ষিণ-পশ্চিমের সাতক্ষীরা থেকে পূর্ব-দক্ষিণের টেকনাফ পর্যন্ত ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় তটরেখা এবং সমুদ্রের ২শ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ‘একান্ত  অর্থনৈতিক এলাকার পরিমান ১ লাখ ১৮ হজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার।
বঙ্গোপসাগরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সহ চিংড়ির প্রজনন প্রক্রিয়া নিরাপদ ও নিশ্চিতকরণ এবং আহরণ প্রবৃদ্ধি টেকসই করতেই ২০১৫ থেকে ’১৮ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ট্রলারের ক্ষেত্রে এবং ২০১৯ সাল থেকে সব মৎস্য নৌযানের ক্ষেত্রেই ৬৫ দিনের আহরণ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। দেশের মৎস্য সম্পদকে সমৃদ্ধ করা সহ জেলে ও মৎস্যজীবীদের ভবিষ্যত জীবন-জীবীকা নিরাপদ করতে এ পদক্ষেপকে ‘বিজ্ঞান সম্মত’ বলেও মনে করছেন মৎস্য বিজ্ঞানীরা।
মৎস্য গবেষনা ইনষ্টিটিউট-এর সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক ড. জুলফিকার আলী জানান, আমাদের বিশাল এলাকার জলরাশির মৎস্য সম্পদ সংরক্ষন, ব্যবস্থাপনা  এবং সুষ্ঠু ও বিজ্ঞানসম্মত সহনশীল আহরণ নিশ্চিত করে সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন অব্যাহত সহ বংশ বৃদ্ধি ও মজুত অক্ষুন্ন রাখতে হবে। তবে এক্ষেত্রে তিনি আমাদের একান্ত বাস্তবতা ও পরিবেশকে বিবেচনায় নিয়ে সামুদ্রিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা নীতি ও কৌশল প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের সাথে সমন্বয় করেই সমুদ্রে মৎস্য আহরণ নিষেধাজ্ঞার সময় নির্ধারন সহ যৌথভাবে কার্যকর করার বিষয়টি বিবেচনা এখন সময়ের দাবী বলেও জানান। তারমতে বঙ্গোপসাগরে আমাদের ‘একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চল’ চিহিৃতকরণে প্রতিবেশী মায়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ায় আমাদের ‘সুনীল অর্থনীতির যে বিশাল সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে তাকে যথাযথ কাজে লাগাতে কালক্ষেপনের কোন সুযোগ নেই। তবে সাগরে ৬৫ দিন মাছধরা নিষিদ্ধ ঘোষনার বিষয়টি নিয়ে উপকূলের জেলে ও মৎস্যজীবীদের মাঝে কিছুটা বিরূপ মনোভাব থাকলেও পুরো সময়কালই ঝড়Ñঝঞ্ঝার মৌসুম বিধায় নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও এসময়ে সাগরে নিরাপদ বিচরন সহ মৎস্য আহরণের সুযোগ খুবই সীমিত বলে আবহাওয়াবীদরা জানিয়েছেন।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT