3:33 pm , June 30, 2024

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ নিরাপদ প্রজননের পরে ইলিশ পোনা-জাটকার নির্বিঘœ বৃদ্ধির লক্ষে ৮ মাসের আহরন নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল গত মধ্যরাতে। পূর্ণাঙ্গ ইলিশ সম্পদে পরিনত করতে জাটকা আহরনে টানা ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় সোমবার ভোর থেকেই জেলেরা বরিশালের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলের নদ-নদীতে জাল ফেলতেও শুরু করবেন। তবে মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধি সহ স্থিতিশীলতা ও টেকসই বিচরনের লক্ষে আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ সীমানায় সব ধরনের মৎস্য আহরন ও পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে বিগত বছরগুলোর মত গত ১ নভেম্বর থেকে ৩০ জুন মধ্যরাত পর্যন্ত বরিশাল সহ সারা দেশেই জাটকা আহরন-পরিবহন ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল। দেশের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে জাটকা আহরনে নিষেধাজ্ঞার এসময়ে বরিশাল সহ সন্নিহিত এলাকায় প্রশাসনের সহায়তায় মৎস্য বিভাগ ভ্রাম্যমান আদালত সহ অভিযান পরিচালনার পাশাপশি নৌবাহিনী, কোষ্ট গার্ড, পুলিশ ও র্যাব সহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও নজরদারী চালায়। এসময়ে জাটকা আহরনে বিরত জেলেদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বরিশাল সহ উপকূলের ৯৭টি উপজেলার ৩ লাখ ৬১ হাজার ৭১টি জেলে পরিবারের মাঝে ৫৭ হাজার ৭৭২ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারী থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে ৪০ কেজি করে এসব চাল বিতরণ করা হয়।
অপরদিকে জাটকা আহরন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে বিগত ৮মাসে বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ১৩ হাজারের মত অভিযান ছাড়াও ২ হাজার ২শ ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে জাটকা আহরনের দায়ে প্রায় দেড় হাজার জেলে ও মৎস্যজীবীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ডাদেশ প্রদান করা হয়েছে। এসময়ে প্রায় ৯০ লাখ টাকা জরিমানা আদায় ছাড়াও প্রায় ২শ কোটি টাকা মূল্যের ১৯ লাখ মিটার নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল ছাড়াও প্রায় ৩১ হাজার অন্যান্য নিষিদ্ধ জাল বাজেয়াপ্ত করে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এসময়ে প্রায় ৩শ টন জাটকা সহ আরো প্রায় সোয়া ২শ টন অন্যান্য মাছ আটক করে বিভিন্ন লিল্লাহ বোর্ডিং এ বিতরণ করে মৎস্য অধিদপ্তর। অভিযানকালে জাটকা আহরনে ব্যবহৃত নৌকা সহ বিভিন্ন মৎস্য উপকরন নিলামে বিক্রী করে সরকারের আয় হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টাকা। অভয়াশ্রম সহ বিভিন্ন নদ-নদীতে জাটকা ছাড়াও অন্যান্য মাছ আহরনের দায়ে প্রায় ২২শটি মামলা দায়ের করেছে মৎস্য অধিদপ্তর।
মৎস্য অধিদপ্তরে মতে, জাতীয় অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান ১%-এরও বেশী। আর মৎস্যখাতে অবদান প্রায় ১২%। এমনকি সারা বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৬০ ভাগই বাংলাদেশে উৎপাদন ও আহরিত হচ্ছে। তবে বরিশাল সহ সন্নিহিত এলাকায় ক্ষতিকর মৎস্য আহরন উপকরনের সাহায্যে যে পরিমান জাটকা আহরন হচ্ছে, তার এক-দশমাংশ রক্ষা করা গেলেও বছরে আরো অন্তত ১ লাখ টন ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব বলে মনে করেন মৎস্য বিজ্ঞানীরা। মৎস্য অধিদপ্তরের দাবী, নজরদারী বৃদ্ধির ফলে দেশে জাটকার উৎপাদন ২০১৫ সালে ৩৯ হাজার ২৬৮ কোটি থেকে ২০১৭ সালে ৪২,২৭৪ কোটিতে উন্নীত হয়। ২০২২ সালের প্রজনন মৌসুমে বরিশাল উপকূল সহ সংলগ্ন অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে প্রায় ৮৪% মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। এরমধ্যে ৫২ ভাগ মা ইলিশ ২২ দিনের মূল প্রজননকালীন সময়ে এবং আরো ৩২% ডিম ছাড়ারত ছিল। যা ছিল অগের বছরের প্রজননকালের চেয়ে প্রায় ২.৪৫% বেশী।
দেশে ইলিশের উৎপাদন আনুপাতিকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০০৮Ñ০৯ সালের ২.৯৮ লাখ টন থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টনে উন্নীত হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ইলিশের সহনীয় আহরন সাড়ে ৫.৬০ লাখ টন থেকে ২২-২৩ অর্থ বছরে ৫.৬৫ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। যা ২৩-২৪ অর্থ বছরে পৌনে ৬ লাখ টনে উন্নীত হবার আশা করছেন মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল মহল। দেশে উৎপাদিত ও সহনীর আহরনের ইলিশের ৬৬-৭০ ভাগই উৎপাদন ও আহরন হচ্ছে বরিশাল অঞ্চলে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে অন্তত ৩০% ইলিশ সারা বছরই ডিম বহন করে। তবে প্রতিদিন ¯্রােতের বিপরীতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলা অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ জীবনচক্রে স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। উপকূলের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে অশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে পর মুক্ত ভাসমান অবস্থায় ছাড়া ডিম থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা, স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে বিচরন করে খাবার গ্রহণ করে বড় হয়ে থাকে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে ৭Ñ১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়াবার পরে জাটকা হিসেব সমুদ্রে চলে গিয়ে পরিপক্কতা অর্জন করে। বঙ্গোপসাগরে ১২-১৮ মাস বিচরণ করে জাটকা পরিপক্ক ও প্রজননক্ষম পূর্ণাঙ্গ ইলিশে পরিনত হয়ে আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।
সমুদ্রে যাবার সময় পর্যন্ত যেসব এলাকায় জাটকা খাদ্য গ্রহণ করে বেড়ে ওঠে, সেগুলোকে ‘গুরুত্বপূর্ণ নার্সারী ক্ষেত্র’ হিসেবে অভয়াশ্রম ঘোষনা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বরিশাল উপকূলে এ ধরনের ৬টি অভয়াশ্রম ঘোষনা করে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ২ থেকে ৩ মাস পর্যন্ত সব ধরনের মৎস্য আহরন নিষিদ্ধ ঘোষনা করায় ইলিশ সহ সব ধরনের মাছেরই নির্বিচার আহরন রহিত হতে সাহায্য করছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তর সহ মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট এর বিজ্ঞানীরা।