3:58 pm , June 29, 2024

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ নবম গ্রেডের একজন নন ক্যাডার প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা বরিশাল সদরের সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল। সরকারি বেতন গ্রেড অনুযায়ী ২২ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫৩ হাজার ৬০ টাকা বেতনের এই কর্মকর্তা বরিশাল ও ঢাকায় সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। নামে বেনামে শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছেন তিনি। আর এই সম্পদ অর্জনে বরিশাল সদর ভূমি অফিসকে ব্যবহার করে তৈরি করেছেন দুর্নীতিবাজদের এক সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেটের কাছে দীর্ঘদিন অসহায় অবস্থায় রয়েছে ভূমি অফিসে সেবা নিতে আসা অসংখ্য সাধারন মানুষ। দুই মোহরার, এক পিয়ন ও সাব রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল এই সিন্ডিকেটের বানানো নিয়মেই চলে বরিশাল সদরের সাব রেজিস্ট্রি অফিস। যেখানে সরকার নির্ধারিত ফি মাফ হলেও সিন্ডিকেটকে দিতে হয় তাদের নির্ধারিত ঘুষের টাকা। জমির দলিলে কোন সমস্যা না থাকলেও বন্টননামা, হেবা দলিল সহ প্রতিটি রেজিস্ট্রির জন্য দিতে হয় কমপক্ষে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা করে। আর সমস্যা থাকলে তো কথাই নেই। সেক্ষেত্রে এই ঘুষের টাকার পরিমান হাজার ছাড়িয়ে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। তাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন জমি মালিকদের সাথে সাথে সকল দলিক লেখকরাও। মূলত দলির লেখকদের মাধ্যমেই কাজগুলো আসে আর টাকা ছাড়া সম্পন্ন হয়না একটি দলিলও। তাই বাধ্য হয়ে সাব রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল এর দালাল হতে না চাইলেও কাজ করতে হচ্ছে ভূমি অফিসের শতাধিক লেখককে। এমন পরিস্থিতিতে এখন দুনীতির আখরায় পরিনত হয়েছে ভূমি অফিস।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জমির মালিক জানান, ঈদের পরে নগরীর ৭৩ শতাংশ একটি জমির আপোষ বন্টননামা সম্পাদনের জন্য যান সাব-রেজিস্ট্রার এর কার্যালয়ে। এক লেখকের মাধ্যমে দলিলটি অসীম কল্লোলের সামনে দেয়া হলে তিনি জানান, আপোষ বন্টননামা দলিল করাতে হলেও নাকি দিতে হবে ৬ শতাংশ উৎস কর। অথচ আপোষ বন্টন নামায় কোন উৎস কর সরকারের ধার্য্য করা নেই। এরপর তাকে কিসের কর এটি জিজ্ঞেস করলে সরাসরি ২ লাখ টাকা দাবি করেন ঘুষ হিসেবে। এর পর তার মোহরার সুশীল চন্দ্র মিস্ত্রি বিষয়টির মধ্যস্থতা করেন এবং সমাধান হয় ১ লাখ টাকার বিনিময়ে। এমন অন্তহীন অভিযোগ প্রতিদিন তৈরি হয় অসীম কল্লোলের বিরুদ্ধে যার একটি ছোট প্রমান এটি। উপজেলা ভূমি অফিস থেকে ভূমি সংক্রান্ত কাগজপত্র সাব রেজিস্ট্রারের সিল স্বাক্ষর ছাড়া পাস হবে না। তাই অসীম কল্লোলের দাবী মানা ছাড়া উপায় নেই কারোরই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি চাকরি করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বরিশাল সদর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল। ঢাকায় এবং বরিশালে ৩টি ফ্ল্যাটসহ সরকারি জমিতে করেছেন চার তলা ভবন, নামে বে-নামে কিনেছেন জমি। ঘুষের টাকার মাধ্যমে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল। তার ব্যক্তিগত সম্পদের তালিকায় রযেছে, শায়েস্তাবাদে ১ একর ২৫ শতাংশ জমি যার দাতা হাসেম হাওলাদার, কাগাসুরা মুকুন্দপট্টি রাস্তার দুই পাশে ৮০ শতাংশ জমি যার দাতা শুক্কুর ম্যাজিস্ট্রেট, কাগাশুরা বাজারের আগে এক একর জমির ওপর দেয়াল ঘেরা একটি মাল্টা বাগান যার দাতা দেখানো হয়েছে আছমত আলি খান নামের একজনকে, ৪নং ওয়ার্ডে ১২ শতাংশের একটি প্লট, লাকুটিয়ায় ২০ শতাংশ জমির ওপরে একটি মুরগীর ফার্ম, রয়েছে তালতলী বাজারে ইট-বালু ও সিমেন্টের দোকান, নগরীর পোর্ট রোডে সরকারি বন্দোবস্ত জমিতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে নির্মাণ করছেন ৫ তলা ভবন (যার কেস নং ২ (৮৯/৯০)। তার পরিবারের সদস্যদের ব্যবহারের জন্য রয়েছে টয়োটা ব্যান্ডের দামি গাড়ি যার নাম্বার (ঢাকা মেট্রো- ঘ-১৩-৬৪৮১)। নগরীর হাসপাতাল রোডে অগ্রণী হাউজিং লিমিটেডের ড্রিম প্যালেসে আছে কোটি টাকার ফ্ল্যাট যার নাম্বার (ফ্ল্যাট নং – ৩-অ)। এই ফ্ল্যাটে তিনি নিজে বসবাস করেন। এছাড়াও রাজধানী ঢাকায় রয়েছে তার আরও দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। বরিশালের একটি ফ্ল্যাটের মূল্যই কমপক্ষে ৭৫ থেকে ৮০ লক্ষ টাকা বলে নিশ্চিত করে সূত্র। ঢাকার ফ্ল্যাট দুটির মূল্য হবে এর কয়েকগুন। এছাড়াও নিজের নামে, স্ত্রীর নামে, ছেলে সন্তানের নামে বেনামে রয়েছে প্রচুর সম্পদ।
অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে বরিশালের সাব রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে দেখা যায়, জমির দলিল করা সহ নানা কাজে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। কার্যালয়টিতে ঘুষ ছাড়া হচ্ছেনা কোন কাজ। অসীম কল্লোল ও তার দুই মোহরারের দুর্নীতিতে বিব্রত খোদ সাব রেজিস্ট্রি অফিসের অন্যান্য কর্মকর্তারাও। দলিল লেখক সমিতি বলছে পুরো অফিসে দুর্নীতির মূল হোতা সাব রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল। মোহরারও বলেন ‘স্যারের নির্দেশনা অনুযায়ীই সব কিছু করেন তারা’। নাল জমি থাকলেও বরিশাল সদর সাব রেজিস্ট্রি অফিসের দুই মোহরার সেটিকে আবাসিক হিসেবে গণ্য করে অতিরিক্ত অর্থ দাবী করছেন বহুদিন যাবৎ। সেই অর্থ আদায় না হলে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। এছাড়া প্রতিটি রেজিস্ট্রিতেই কমবেশি টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে। ভুক্তভোগারী বলেন, টাকা দিলেই সব ঠিক ঠাক, আর না দিলেই নানা ধরণের ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয় তাদের। ওই অফিসের মোহরার মাহাবুব আলম, এনছান ও সুশীল চন্দ্র মিস্ত্রি এর মূল হোতা। সাথে দুর্নীতির বরপুত্র হিসেবে রয়েছেন অফিস সহায়ক জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীরের ভিন্ন কাজ থাকলেও সে কাজ করছেন টিপ সই নেওয়ার। অভিযোগ টিপ সই নেওয়ার পাশাপাশি প্রতি ব্যক্তির কাছ থেকে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকেন এই জাহাঙ্গীর। দলিল লেখক সমিতির সদস্যরা বলছেন জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে সাব রেজিস্ট্রারের নির্দেশে কয়েকজন কর্মচারী। অসীম কল্লোল, সুশীল, এনছান ও জাহাঙ্গীর সাব রেজিস্ট্রি অফিসটিকে নিজেদের পৈত্রিক সম্পত্তি বানিয়ে লুটপাট চালাচ্ছে দেদারছে। এদের মধ্যে সুশীলের বিরুদ্ধে চলছে তদন্তও। অন্যদিকে মোহরার সুশীল, এনছান ও জাহাঙ্গীরের বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছেন সাব রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল নিজেই। তবে তার নির্দেশেই সব ধরণের দুর্নীতি করে থাকে কয়েকজন কর্মচারী এমন অভিযোগ বহুদিনের। ভুক্তভোগীরা দ্রুত এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে অপসারণসহ শাস্তির আওতায় আনার দাবী জানান।
এসকল বিষয়ে আলাপে অসীম কল্লোল তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবী করেছেন। একই সুর ধরেছেন অন্য অভিযুক্তরাও। তবে সম্পদের বিষয়ে অসীম কল্লোল বলেন, এত সম্পত্তি আমার নেই। তবে বরিশালে ১টি, ঢাকায় ২টি ফ্ল্যাটটসহ ৫ তলা ভবন আছে বলে স্বীকার করেছেন। সাথে কিছু জায়গা রয়েছে বলেও স্বীকার করেন তিনি।
অভিযোগকারীদের দাবি, অসীম কল্লোল এর দুর্র্নীতি ওপেন সিক্রেট । তবে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কেউ কোন প্রতিবাদ করেনা। অল্প কিছুদিনের মধ্যে এই কর্মকর্তা অবসরে যাচ্ছেন। তাই শেষ সময়ে এখন তিনি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। এমন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদক সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদন্তের জোর দাবী জানিয়েছেন তারা।