4:17 pm , June 21, 2024

অব্যবস্থাপনায় লাগাতার যানজট
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ ঈদ পরবর্তী কর্মস্থলমুখী জন¯্রােতে বরিশালÑফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাসড়কের বরিশাল থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৯১ কিলোমিটার অংশের নিত্য যানজটে নাকাল হচ্ছেন হাজার হাজার যাত্রী। দেশের ৮ নম্বর এ জাতীয় মহাসড়কের বরিশাল মহানগরীর নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে রহমতপুর, উজিরপুরে টোলপ্লাজা, বাটাজোড়, গৌরনদী, টরকী, ভূরঘাটা, টেকেরহাট, রাজৈর এবং ভাঙ্গাতে বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে ও সার্ভিস রোডের সংযোগস্থলে তীব্র যানজট প্রতিদিনই হাজার হাজার যাত্রীকে চরম দুর্ভোগে ফেলছে। এসব স্পর্শকাতর স্থানগুলোতে রাস্তার শোল্ডারে বাস কাউন্টার এবং বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের অবৈধ পার্কিং দিনরাতই নানামুখী সংকট তৈরী করলেও তা থেকে উত্তরণ কঠিন হয়ে পড়েছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বরিশাল মহানগর ও জেলা পুলিশ ছাড়াও হাইওয়েপুলিশের সব প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। তবে পাশাপাশি অনেক স্থানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতদার অভিযোগ উঠছে।
সারাবছর জুড়েই এসব স্থানগুলোতে কমবেশী যানজট অব্যাহত থাকলেও ঈদের আগে ও পরে বরিশাল সহ সন্নিহিত এলাকার ঘরমুখী ও কর্মস্থলমুখী প্রায় ১০ লাখ মানষের চলাচলে যানবাহনের সংখ্যা কয়েকগুন বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। এমনকি পদ্মা সেতু চালু হবার পরে বিভিন্ন সড়ক পরিবহন কোম্পানীগুলো রুট পারমিটের কয়েকগুন বেশী যানবাহন এ পথ চালালেও তা দেখার কেউ নেই। বেশকিছু নামিদামি পরিবহন সংস্থাগুলো সরকার নির্ধারিত ভাড়ার দেড় থেকে দুই গুন পর্যন্ত যাত্রীভাড়া আদায় করলেও বিষয়টি নিয়ে কোন আইনগত ব্যবস্থা অনুপস্থিত।
তবে ঈদের আগের ৪ দিনের মত ঈদ পরবর্তী প্রথম কর্মদিবস থেকেই বরিশালÑফরিদপুর-ঢাকা জাতীয় মহাসড়কের ভাঙ্গায় এক্সপ্রেস ওয়ের শেষপ্রান্ত থেকে বরিশাল পর্যন্ত ৯১ কিলোমিটার মহাসড়কে ভায়াবহ যানজট সুষ্ঠু পরিবহন ব্যবস্থাকে জটিল করে তুলেছে। অথচ গৌরনদী ও ভাঙ্গাতে হাইওয়ে পুলিশ, থানা ছাড়াও ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। কিন্তু শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও এ মহাসড়কের গৌরনদী, বাটাজোড়, উজিরপুর টোল প্লাজা বরিশাল মহানগরীর রূপাতলী ও নথুল্লাবাদের দুটি বাস টার্মিনাল ছাড়াও ভুরঘাটা, মোস্তফাপুর, রাজৈর, টেকেরহাট ও ভাঙ্গাতে তীব্র যানযট হাজার হাজার যাত্রীকে চরম ভোগান্তিতে ফেলে।
এমনকি গৌরনদী, টরকী ও বাটাজোড়ে যানজট এ যাবতকালের সব রেকর্ড অতিক্রম করে শুক্রবার দুপুরের আগেই। এসব এলাকায় অবৈধ পার্কিং ছাড়াও বরিশাল মহানগরী থেকে ভাঙ্গায় বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে পর্যন্ত ৯১ কিলোমিটার মহাসড়কটি মাত্র ১৮ ফুট থেকে ২৪ ফুট প্রশস্ত হওয়ায় যানজটের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি করছে। ১৯৬০-’৬৬ সালের মধ্যে মাত্র ১২ ফুট প্রশস্ত করে ৫ টন বহন ক্ষমতার যানবাহনের জন্য নির্মিত হলেও সেখানে এখন ৩০-৩৫ টন বহন ক্ষমমতার যানবাহনও চলাচল করছে। যানবাহনের সংখ্যাও বেড়েছে অন্তত ২৫ গুন। তবে গত প্রায় ৬০ বছরে মহাসড়কটি পুন:নির্মান সহ এর ধারন ক্ষমতা বাড়েনি।
উপরন্তু দুইপাশের নানা ধরনের অবৈধ স্থাপনা মহাসড়কটিকে গলা টিপে ধরছে। বাড়তি ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে অবৈধ যানবাহনের আধিক্য। বাড়ছে দুর্ঘটনার সংখ্যা। সড়ক অধিদপ্তর ও হাইওয়ে পুলিশের একাধিক সূত্রের মতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রায় সমান ১৮ হাজার যানবাহন চলাচল করছে বরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা মহাসড়কেও। অথচ দেশের ১ নম্বর জাতীয় মহাসড়কটি ৬ লেনের। আর বরিশাল-ফরিদপুর জাতীয় মহাসড়কটি সিঙ্গেল লেনের। প্রতিদিন এ মহাসড়কে কমপক্ষে ৫টি করে দুর্ঘটনা ঘটছে। গত ৫ মাসে এ মহাসড়কে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় অন্তত ৩০ জনের প্রাণহানী ঘটেছে। আহত হয়েছেন আরো দু শতাধিক। এমনকি নিত্যদিনের যানজট ও দুর্ঘটনায় এ মহাসড়ক দিয়ে পণ্য পরিরবহনেও দীর্ঘ সময় ব্যয় হচ্ছে।
পদ্মা সেতু চালু হবার পরে ভাঙ্গা থেকে বরিশাল পর্যন্ত ৯১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেই বিভিন্ন যানবাহনের প্রায় সোয়া ৩ ঘন্টা সময় লাগলেও বিগত ১৪ জুন থেকে ৪ ঘন্টারও বেশী সময় চলে যাচ্ছে। ফলে পদ্মা সেতু চালুর পরে দ্রুত সময়ে ঢাকা ও সন্নিহিত এলাকায় পৌঁছানোর আশা ক্রমে ম্লান হচ্ছে।
অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বরিশাল থেকে ফরিদপুর পর্যন্ত জাতীয় মহাসড়কটি ৬ লেনে উন্নীত করনের লক্ষ্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ২০১৮ সালে শেষ হয়। এমনকি সমীক্ষার পথ নকশা অনুযায়ী প্রায় সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে ১৮শ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে একটি আলাদা প্রকল্পও অনুমোদন করা হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের ৩ বছর পরেও ভূমি অধিগ্রহণ কাজের অর্ধেকও সম্পন্ন হয়নি। তবে ঐসব জমির বর্তমান বাজার মূল্য দ্বিগুনেরও বেশী বৃদ্ধি সহ নতুন পথনকশা অনুযায়ী বাড়তি প্রায় ২শ হেক্টর সহ জমির মূল্য পরিশোধেই দ্বিগুনেরও বেশী অর্থের প্রয়োজন হবে বলে জানা গেছে।
এমনকি বাস্তবতার আলোকে পরবর্তীতে বরিশাল মহানগরীকে এড়িয়ে প্রায় ১৬ কিলোমিটার বাইপাস নির্মানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সংশোধিত ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা-ডিপিপি’ তৈরীর কথাও জানিয়েছে সড়ক অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র।
উপরন্তু দাতা সংগ্রহের বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে এডিবি ছাড়াও আরো কয়েকটি দাতা সংস্থার সাথে প্রকল্পটির অর্থায়নে কথা চলছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। অপরদিকে ২০১৫ থেকে ’১৮ সালের মধ্যে সম্ভাব্যতা সমিক্ষা ও পথনকশা অনুযায়ী ফরিদপুর থেকে বরিশাল হয়ে সাগরপাড় পর্যন্ত ২১১ কিলোমিটার মহাসড়কটি ৬ লেনে উন্নীতকরণে সম্ভাব্য ব্যয় ২১ হাজার কোটি টাকা ধরা হলেও ভূমি অধিগ্রহণেই অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত প্রয়োজন হতে পারে। ফরে প্রকল্প ব্যয় কত বৃদ্ধি পাবে তা এখনো অজ্ঞাত।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি’র অর্থে সমীক্ষা ও নকশা প্রস্তুত হলেও ইতোমধ্যে দাতা সংস্থাটি পূর্বের সব কিছু সংশোধন করে নতুন সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সহ পরিপূর্ণ নকশা প্রনয়নের কথা বলেছে। সে লক্ষ্যে কাজও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।
তবে দাতা সংগ্রহ সহ চুক্তি স্বাক্ষরের পরে কবে নাগাদ বরিশাল-ফরিদপুর জাতীয় মহাসড়কটি ৬ লেনে উন্নীতকরণ সহ এ অঞ্চলের মানুষের ভোগান্তি কমবে তা বলতে পারছেন না সড়ক অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কোন মহল।