4:46 pm , June 9, 2024

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বঙ্গোপসাগর থেকে ধয়ে আসা আরেক ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’কে রুখে দিয়ে আবারো ক্ষত বিক্ষত উপকূলীয় বনায়ন কর্মসূচীর প্রায় আড়াই লাখ হেক্টরের বনভূমি সহ সাধারন মানুষের বিশাল বনজ সম্পদ। গত ২৭ মে রাত থেকে ২৮ মে দুুপুর পর্যন্ত টানা ১৮ ঘন্টা ধরে ঘূর্ণিঝড় রিমাল বরিশাল উপকূলে তান্ডব চালিয়ে মূল ভূ-খন্ডের ভেতরে এসে দুর্বল হয়ে মিলিয়ে গেলেও উপকূলের মৎস্য, প্রাণি সম্পদ, কৃষি ও বনজ সম্পদ সহ বিভিন্ন অবকাঠামোর ওপর তার ভয়াল ছোবলের ক্ষত রেখে গেছে। শুধুমাত্র বরিশাল উপকূলের কৃষি, পানি ও মৎস্য সম্পদ সহ বনজ সম্পদের প্রাথমিক ক্ষতি প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা বলে সরকারি হিসেবে বলা হয়েছে। তবে ভয়াল ‘সিডর’, ‘আইলা’, ‘মহাসেন’ ‘আম্পান’ ও ‘ইয়াস’এর পরে ‘রিমাল’এর ঝড়-জলোচ্ছাস প্রতিহত করতে বিশাল উপকূলীয় বনভূমি ‘প্রাকৃতিক ঢাল’ হিসেবেই কাজ করেছে। উপকূলীয় বনজ সম্পদ না থাকলে জান-মালের ক্ষতি আরো কয়েকগুন বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো বলে মনে করছেন পরিবেশবীদরা। উপকূলের বিশাল সম্পদ সহ জনগোষ্ঠীর জানমাল রক্ষায় এবারো উপকূলীয় বনাঞ্চল বুক পেতে দিলেও তার সম্প্রসারণ ,উন্নয়ন ও রক্ষনাবেক্ষনে এখন আর কোন প্রকল্প বা কর্মসূচী নেই।
অথচ উপকূলীয় বন দেশের ‘প্রাকৃতিক ভারসাম্যের রক্ষাকবজ’ বলে উল্লেখ করে ‘এ বন বাঁচলে উপকূল বাঁচবে’ বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট পরিবেশবীদরা। তাদের মতে, ‘যেকোন উপায়ে উপকূলীয় বনভূমি রক্ষা সহ আরো সম্প্রসারণের কোন বিকল্প নেই’ । তাদের মতে ‘উপকূল সহ সারা দেশের পরিবেশ সুরক্ষায় উপকূলীয় বনভূমি রক্ষা ও সম্প্রসারণে যেকোন উদাসীনতা হবে আত্মহত্যার শামিল’।
ভারত, ব্রাজিল ও মালয়েশিয়ার কয়েকজন গবেষক ২০২১ সালে সুন্দরবন সহ বরিশাল অঞ্চলের উপকূলীয় বন বাগান পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন। ঐসব গবেষকদের গবেষনার ফলাফল আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘এলসেভিয়ায়ের এষ্টুয়ারিন, কোষ্টাল এন্ড সেলফ সায়েন্স জর্নাল’এ প্রকাশিত হয়। ঐ গবেষনাপত্রে আম্পান সহ সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়গুলোতে বরিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের বনের ক্ষতি ৫৬.১৯ শতাংশ এলাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এমনকি আম্পানের কারণে উপকূলীয় ম্যনগ্রোভ বা লবনাম্বুজ বনের সব অংশেরই অবনতি সহ ভাঙন দেখা দিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৯৬৬ সাল থেকে বিশ^ব্যাংক সহ বিভিন্ন দাতা ও সাহায্য সংস্থার অর্থায়ন ছাড়াও দেশের নিজস্ব সম্পদে যে প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর উপকূলীয় বনভূমি গড়ে উঠেছে, তার অন্তত ৩০ভাগ ইতোমধ্যে বিনষ্ট হয়েছে। প্রতিটি ঝড়ঝঞ্ঝায় উপকূলভাগের বিপুল সংখ্যক গাছপালা বিনষ্ট হলেও সে ক্ষতি পূরণের উদ্যোগ জোরাল নয়। সাম্প্রতিককালে উপকূলীয় এলাকায় নতুন বন সৃজনে কোন প্রকল্প না থাকায় বিদ্যমান ও ক্ষতিগ্রস্ত বনভূমির স্থায়িত্ব ও টেকসই ধারা অব্যাহত থাকছে না।
এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, ১৮৭৭ সাল থেকে মে ২০২৪ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর থেকে অন্তত অর্ধশতাধিক তীব্র ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও ৪৯ বার ঘূর্ণিঝড় ও ২০ বার ‘হেরিকেন’ মাত্রার ঘূর্ণিঝড় আমাদের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হেনেছে। বন বিভাগের একটি দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’এর আঘাতে উপকূলীয় বনের প্রায় সাড়ে ১১ হাজার হেক্টরে আর্থিক ক্ষতির পরিমান ছিল প্রায় পৌনে ৪শ কোটি টাকা। ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’এ প্রায় ১২ হাজার হেক্টরের বনবাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০২১ সালের মে মাসের ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’এর প্রভাবে সাড়ে ৬ হাজার হেক্টরের ম্যানগ্রাভ বাগান, পৌনে ২শ হেক্টরের স্ট্রীপ, গোলপাতা ও ঝাউ বাগান ছাড়াও প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার হেক্টরের নার্সারী চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমান ছিল প্রায় ২০ কোটি টাকা। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে ২৪৮ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’এর আঘাত প্রতিহত করতে গিয়ে বরিশাল উপকূলের প্রায় ১ কোটি সরকারি ও বেসরকারী গাছপালা বিনষ্ট হয়। আর সবশেষ ঘূর্ণিঝড় ‘রিমেল’ এর আঘাতে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল,সৃজিত বন বাগান ও নার্সারি সমূহের বিপুল সংখ্যক চারার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিক হিসেবে ক্ষতির পরিমান শতাধিক কোটি টাকা।
কিন্তু ১৯৬৬ সাল থেকে দেশের উপকূলভাগে বনায়ন কার্যক্রম শুরু হলেও এখন এ লক্ষ্যে আর কোন বাস্তব উদ্যোগ নেই। তবে বছর পাঁচেক আগে ১০৪ কোটি টাকার সম্পূর্ণ দেশীয় তহবিলে ‘বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা চরাঞ্চলে বনায়ন নামে একটি প্রকল্পের আওতায় ২৫ হাজার হেক্টরে নতুন বনায়ন সহ এক হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও বিভিন্ন সড়কে বৃক্ষ রোপনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়েছে। এক বছর মেয়াদ ও প্রকল্প ব্যয় ৩ কোটি টাকা বৃদ্ধি করে উপকূলের ৪০ হাজার বসতবাড়ী সহ ১০টি জেলায় এ বনায়ন সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় উপকূলের ৪০ হাজার বসতবাড়ীতে ২০টি করে চারা রেপনের মাধ্যমে বনায়নের কর্মসূচী বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছেন বরিশাল কোষ্টাল সার্কেলের বন সংরক্ষক। তবে ‘গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড’এর সহায়তায় উপকূলীয় এলাকায় বনায়নের একটি ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা’ প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।
সরকার বঙ্গোসাগরের কোল ঘেষে দেশের ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় তটরেখার ৪৮টি উপজেলার ৪৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ‘উপকূলীয় এলাকা’ হিসেবে চিহিৃত করেছে। যা দেশের মোট আয়তনের ৩০%। মোট জনসংখ্যার ২৮% মানুষ উপকূলীয় এসব ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাস করে। উপকূলীয় এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠী সহ সম্পদকে রক্ষায় ১৯৬৬ সাল থেকে যে বনায়ন শুরু হয়, তারই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় উপকূলভাগে ইতোপূর্বে প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর সরকারি খাস জমিতে ‘লবনাম্বুজ বন বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’ সহ বিভিন্ন ধরনের বনায়ন হয়েছে।
কিন্তু বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা একের পর এক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস প্রতিহত করতে গিয়ে উপকূলীয় বনভূমী ইতোমধ্যে অনেকটাই ক্ষতবিক্ষত। সিডরের ক্ষতি পূরণের আগেই পরবর্র্তি ৩ বছরে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ ও ‘আইলা’ উপকূলীয় বনবাগান সহ বিশাল জনপদকে আরো ক্ষতবিক্ষত করে।
গত কয়েক বছর ধরে বৃষ্টির অভাবে উজান থেকে নদ-নদীর প্রবাহ আশংকাজনকভাবে হ্রাসের ফলে সাগরের লবনাক্ত পানি উপকূল থেকে বরিশাল অতিক্রম করে চাঁদপুরে ভাটিতে মেঘনার হিজলা পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। উপকূলীয় এলাকা ও এর নদ-নদীগুলোতে লবনাক্ততার মাত্রা অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় বেড়ে যাওয়ায় বনের ক্ষতিও বাড়ছে। আবার অনেক চরাঞ্চলে ক্রমাগত পলি পড়ে ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে গাছ পর্যাপ্ত পানি পচ্ছেনা। ফলে তার টেকসই স্থায়িত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পলি জমে উপকূলের নদী ও খাল ভরাট হবার কারণেও বনের ইকোসিষ্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে একাধিক গবেষনাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
আবার নদী ভাঙনেও উপকূলীয় এলাকায় প্রতিবছর প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর বনভূমী বিলীন হয়েছে। উপকূলীয় বনায়নে আর্থিক সহায়তাকারী বিশ^ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ১৯৭৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছরে দেশের উপকূলীয় এলাকায় ১৪৪ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি হ্রাস পাবার কথা বলা হয়েছে।
ইয়াস, বুলবুল, আম্পান, মহাসেন, সিডর ও রিমেল সহ একাধিক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছাসের ছোবলে বরিশাল উপকূলের উপকূলীয় বনভূমি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত ১৫ বছরে শুধু খেপুপাড়া সংলগ্ন উপকূলীয় বনাঞ্চলের প্রায় ৬৪ ভাগ বনভূমি সাগরের ঢেউ সহ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইকোপার্ক, নারকেল বাগান ও ঝাউ বাগান সহ লবানাম্বুজ বনের বেশীরভাগ এলাকাই বিলীন হয়েছে।
এসব ব্যাপারে বরিশাল কোষ্টাল সার্কেলের বন সংরক্ষক জানান, বনভূমির ক্ষয়ক্ষতি পুনর্বাসনে কোন প্রকল্প বা কর্মসূচী অপাতত না থাকলেও আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি বনভূমি রক্ষার।