4:06 pm , June 7, 2024

জুবায়ের হোসেন ॥ একদিন আগে ঘোষনা করা হয়েছে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনে বৃহস্পতিবার বাজেট উপস্থাপন করছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বাস্তবায়ন এমনকি ঘোষনার আগ থেকেই বাজেটের প্রভাব পড়েছে সারা দেশের নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব ধরনের পণ্যের কেনাকাটায়। বরিশাল নগরীতেও আগামী অর্থবছরের বাজেটের প্রভাবে এক রকম এলোমেলো অবস্থায় রয়েছে বাজারের পরিস্থিতি। ঘোষিত প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে সাধারন শ্রেণির বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের পরিপূর্ণ জ্ঞান বা জানাশোনা না থাকলেও বাজেট মানেই পণ্যের দাম বাড়াতে হবে, কিংবা দাম বাড়ার আশায় পণ্যের সিন্ডিকেট তৈরি করতে হবে এমন চেষ্টাই লক্ষ্য করা গেছে নগরীর বিক্রেতাদের মধ্যে। অন্যদিকে বাজেটকে ঘিরে বরাবরের মত মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সাধারন ভোক্তা শ্রেণি। সচেতন মহলের মতে বাজেট নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে অহেতুক দ্রব্য মূল্য বাড়ানো অথবা সিন্ডিকেট করা গুরুতর অপরাধ। যারা এমন করে তারা আইনের আওতায় আসার মত অপরাধী। অন্যদিকে বিভ্রান্ত না হয়ে ঘোষিত বাজেট বোঝার চেষ্টা করা সাধারন নাগরিকদের দায়িত্ব। তাই বাজেটে কোন পণ্যের দাম বাড়বে, আর কোন পণ্যের দাম কমবে তা সঠিকভাবে জানাও জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন সচেতনরা।
গতকাল নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাজারে বাজেটের প্রভাব দেখতে গিয়ে দেখা গেছে মুদি দোকান থেকে শুরু করে সুপার শপ পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের এলোমেলো দামের বিষয়টি। যেখানে প্রস্তাবিত বাজেটে উল্লেখ করা পণ্যের দাম কমবে: চাল, ভোজ্যতেল, চিনি, গুঁড়ো দুধ, চকলেট, ল্যাপটপ, মোটরসাইকেল, ডেঙ্গুর চিকিৎসা সামগ্রী, আমদানিকৃত কিডনি ডায়ালাইসিস ফিল্টার ও সার্কিট, ক্যানসার চিকিৎসা সরঞ্জাম, কার্পেট, সুইচ-ছকেট, ইলেকট্রিক মোটর, লোহা জাতীয় পণ্য (রড, বার ও এঙ্গেল), উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ ও মিথানল। সেখানে চাল, চিনি গুড়ো দুধের দাম পূর্বের তুলনায় কেজিতে কিছুটা বাড়তি নিতে দেখা গেছে খুচরা দোকান গুলোতে। গুড়ো দুধ, চকলেট এর চাহিদাপূর্ণ পণ্য গুলো পাওয়া যায়নি অনেক দোকানেই। দাম বাড়তে পারে এমনটা জানিয়ে ডিলার ডিস্টিবিউটররা পণ্য দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে খুচরা ব্যবসায়িদের। তাই পণ্য চাহিদার তুলনায় কম থাকায় ক্রেতারাই অনেক ক্ষেত্রে বেশি মূল্য দিয়ে কিনে নিচ্ছে বলে জানান খুচরা ব্যবসায়িরা।
অপরদিকে বাজেটে দাম বাড়ার কথা উল্লেখ রয়েছে মোবাইলের এসএমএস-কলরেট, সিগারেট, এয়ারকন্ডিশনার ও রেফ্রিজারেটর, কাজু বাদাম, আইসক্রিম, পানির ফিল্টার, এলইডি বাল্ব, গাড়ি কনভার্সন খরচ, ফার্নেস অয়েল, লুব অয়েল, মিনারেল লুব অয়েল ও বেজ অয়েল, ফিলিং স্টেশন স্থাপন, সিএনজি কনভার্সন কিট ও সিলিন্ডার, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইকুইপমেন্ট, ইপিজেডের আমদানিকৃত যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ সামগ্রী, কার্বনেটেড বেভারেজ, এমিউজমেন্ট পার্ক, থিম পার্ক ও পর্যটন। বাজেটটি এখনো প্রস্তাবিত হলেও ইতিমধ্যেই দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে এসএমএস কলরেট, সিগারেট, এয়ারকন্ডিশনার ও রেফ্রিজারেটর, আইসক্রিম, পানির ফিল্টার, এলইডি বাল্ব, লুব অয়েল, মিনারেল লুব অয়েল ও বেজ অয়েল, সিএনজি কনভার্সন কিট ও সিলিন্ডার, কার্বনেটেড বেভারেজ সহ সব পণ্যের। এসকল পণ্যের দাম কি হারে বাড়ানো হবে তা বাজেটে উল্লেখ না থাকলেও অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়িরা নিজেদের ইচ্ছা মত করেই বাড়িয়ে রাখছেন পণ্যগুলোর দাম। এদের সাথে তর্কে গিয়েও কোন লাভ হচ্ছে না বলে দাবী করেছেন নগরীর ভোক্তারা। তাদের দাবী সরকার বাজেট প্রণয়ন করেছে তা বাস্তবায়িত হলে অবশ্যই সে দামেই পণ্য কিনবেন। তবে আগে কেন এলোমেল ভাবে দাম বাড়িয়ে বাজারের পরিস্থিতি নষ্ট করা হচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের তদারকি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে অনেকে।
নগরীর একটি সুপার শপে কেনাকাটা করতে আশা নারী রিজিয়া পরভীন জানান, বাজেট হয়েছে গতকাল। এর মধ্যেই দাম বাড়িয়েছে প্রায় সব পণ্যের। এত দ্রুত কিভাবে দাম বাড়লো তা আসলে বুঝতে পারছেন না বলে জানান এই নারী। তবে বাঁচতে হলে খেতে হবে তাই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। ক্রেতাদের আসলে কিছুই করার নেই বলে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি।
সড়কের পাশে টং দোকান থেকে সিগারেট কিনতে আসা যুবক আরিফ জানান, প্রতি বছরের ন্যায় এবারো বাজেটে যে সিগারেটের দাম বাড়বে তা আগেই বুঝতে পেরেছেন। তবে গত এক সপ্তাহ থেকে সংকট দেখিয়ে সিগারেটের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে বাজেট প্রনয়ন করার আগেই। তামাক জাত পণ্যের দাম বাড়ানো ভালো উদ্যোগ জানিয়ে তিনি বলেন, বাড়ানো দাম থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব যদি সরকার পেত তবে দুঃখ থাকতো না। কিন্তু সংকট দেখিয়ে সিন্ডিকেট করে ডিলার ডিস্টিবিউটররা দামটি বাড়িয়ে মুনাফা পকেটে নিয়েছে যা দুঃখজনক বিষয়।
নগরীর মোবাইল দোকানে রিচার্জ করতে আসা কলেজ শিক্ষার্থী ফারজানা জানান, আগে ৯৯ টাকায় ১৩০ মিনিট কিনতেন সাত দিনের মেয়াদে। গতকাল একই রিচার্জে পেয়েছেন ১১০ মিনিট। মানে বাজেট ঘোষনার সাথে সাথেই মোবাইল অপারেটররা ফায়দা নিয়ে গ্রাহকের গলাকাটা শুরু করেছে।
রিকশাচালক আলাউদ্দিন ফরাজি জানান, সারাদিন খেটে মহাজনকে ভাড়া পরিশোধ করে ৫০০-৬০০ টাকা আয় করতে কষ্ট হয় তার। এর মধ্যেই ছেলে-মেয়ের পড়াশুনা, চিকিৎসা, খাদ্য সহ সব মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হয়। কি বাজেট হয়েছে, কিসের দাম বেড়েছে আগাগোড়া কিছু না বুঝলেও বাজারে গেলেই বাজেটের বাহানায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হচ্ছে চড়া মূল্যে। মূলত পরিবেশ পরিস্থিতি যেমনই হোক না কে ভোগান্তি শেষমেষ নিম্ন আয়ের মানুষকেই পোহাতে হয়।
এ বিষয়ে নগরীর সব বিক্রেতাদের সাথে আলাপ করা হয়। খুচরা ব্যবসায়িরা জানান, দোষ সব ডিলারদের। ডিলারদের সাথে আলাপ করলে তারা বলেন ডিস্টিবিউটররা দিচ্ছে না চাহিদা অনুযায়ী পণ্য। তাই এমন পরিস্থিতি। তবে বাজেট এখনো কর্যকরী না হলেও কিভাবে কোন পণ্যের দাম না কমিয়ে শুধুমাত্র বাড়ানোই হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তর ছিলো না কারো কাছেই।
উল্লেখ্য আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে এবারের বাজেটের আকার বাড়ছে চার দশমিক ছয় শতাংশ। এটি দেশের ৫৩তম, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৫তম ও অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট। বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। বাকি দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা থাকবে। দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ইতোমধ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশের বেশি নির্ধারণ করা হয়েছিল এবং আগামী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ছয় দশমিক ৭৫ শতাংশ হতে পারে। প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৪১ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। পরে এটি সংশোধন করে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা করা হয়।