4:01 pm , May 29, 2024

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ প্রকৃতিক দুর্যোগ প্রবন বরিশাল উপকূলে মৃত্যু আর ধ্বংস নিয়ে বছরের প্রথম ঘূর্ণিঝড় ‘রেমেল’এর তান্ডবে কৃষি,মৎস্য প্রাণিসম্পদ ও বনাঞ্চলের ক্ষতির পরিমান প্রায় হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে কয়েক লাখ ঘরবাড়ি ছাড়াও সড়ক,সেতু ও কালভার্ট এবং বিদ্যুৎ অবকাঠামো সহ সরকারী-বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সম্পদের ক্ষতি আরো হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করবে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। প্রতি বছরই বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ছোট-বড় ঘূর্ণিঝড় বরিশাল উপকূলে আছড়ে পড়ে। কেড়ে নেয় বহু মানুষের প্রাণ। সম্পদের ক্ষতিও হয় বিপুল। এবারের ঝড়ে বরিশাল বিভাগে ইতোমধ্যে ১৩ জনের মৃত্যুর কথা বলেছে প্রশাসন। প্রায় ৫ লাখ ২৮ হাজার পরিবারের ২২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও প্রায় ১৬ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও ৭৩ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ছে। বরিশালে ১৯৮৫ সালে নির্মিত বিএডিসি’র সার গুদামে প্রথমবারের মত জোয়ারের পানি প্রবেশ করে প্রায় হাজার টন সার সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে। এছাড়া নগরীর পাইকারী চালের আড়ত ফরিয়াপট্টিতেও কীর্তনখোলার জোয়ারে শত শত টন চাল নিমজ্জিত হয়ে ব্যবসায়ীদের সর্বশান্ত করে দিয়েছে। বরিশালের বিভাগীয় প্রশাসন জেলা ও উপজেলা থেকে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ খেপুপাড়া সহ উপকূলের ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকা সরেজমিনে পর্যবেক্ষনে আসছেন।
গত রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে সোমবার দুপুর ৩টা পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় রিমেল প্রায় ১৮ ঘন্টা ধরে থেমে থেমে তান্ডব চালায়। বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা রিমেল রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় কুয়াকাটা সৈকত হয়ে ২২ কিলোমিটার উত্তরে খেপুপাড়ায় আছড়ে পড়ে। সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে খেপুপাড়া রাডার স্টেশন ঝড়টির ৬৫ কিলোমিটার গতি রেকর্ড করে। কিন্তু রাত ১১টার পরে প্রায় ৮৬ কিলোমিটার উত্তরে বরিশাল মহানগরীতে ঝড়ের গতি ছিল ৭৮ কিলোমিটার। শেষরাত হয়ে সকালের মধ্যেই রিমেল’এর তীব্রতা অনেকাংশে হ্রাস পাবার পরে জনমনে কিছুটা স্বস্তি নেমে আসে। সকাল ১০টার পরে আবহাওয়া বিভাগ থেকে পায়রা সমুদ্র বন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর দুরবর্তী সতর্ক সংকেত দেখাতে বলে। বরিশাল নদী বন্দরকেও ৪ নম্বর নৌ হুশিয়ারী সংকেতের পরিবর্তে ২ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলে।
কিন্তু বেলা ১১টা থেকেই বরিশাল সহ উপকূল এলাকায় বাতাসের তীব্রতার সাথে বৃষ্টিপাতের পরিমান পুনরায় বাড়তে থােেক। দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটে বরিশাল আবহাওয়া অফিস রিমেল পরবর্তি ঝড়ের গতিবেগ ৯০ কিলোমিটার রেকর্ড করে। অপরদিকে রোববার সকাল ৬টা থেকে রিমেল এর রাত পেরিয়ে সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত বরিশালে ৪১ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও রিমেল সরে যাবার পরে ওইদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বরিশালে বৃষ্টি হয়েছে প্রায় ১শ মিলিমিটার। সোমবার বেলা ১১টার পরের জোয়ারে বরিশাল মহানগরী সহ সমগ্র উপকূলীয় এলাকায় জোয়ারের তোড়ে ভেসে যায়। এভাবে ঘূর্ণিঝড় সরে যাবার পরে এবং সতর্ক সংকেত হ্রাস করা হলেও ঝড়ের তান্ডব আর কখনো প্রত্যক্ষ করেনি উপকূলবাসী।
বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমানাজুড়ে বিস্তীর্ণ জলরাশির সঞ্চালন সুনীল ঢেউ-এর মাথায় যে রূপালী উর্মিমালা আলিঙ্গন করছে, বিশ্ব মানচিত্রে তা-ই বঙ্গোপসাগর। পৃথিবীর অন্যসব সাগরের মতই প্রকৃতির সব লীলার সঙ্গিনী হয়ে মেতে আছে আমাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বঙ্গোপসাগরও। প্রকৃতির সাথে বঙ্গোপসাগরের বিচিত্র লীলার যে ভয়ঙ্কর রূপ, তার অস্তিত্ব অনুভব করতে গিয়ে উপকূলবাসীকে বারবারই চরম মূল্য দিতে হয়েছে। গত রোববারও সন্ধ্যা থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত টানা ১৮ ঘন্টা ধরে চলে প্রকৃতির আরেক রুদ্ররোষ ঘূর্ণিঝড় রিমেল-এর তন্ডব।
রিমেল-এর তান্ডবে আউশ বীজতলা, রোপা আউশ, চীনাবাদাম মরিচ, তিল, ফেলন, শাক-সবজি, পাট, পান, কলা, পেপে সহ বিভিন্ন ধরনের মৌসুমী ফলের ক্ষতির পরিমান প্রায় ১.৭০ লাখ টনের মত। গড় ক্ষতির হার প্রায় ২৬%। যার মূল্য প্রায় ৫০৯ কোটি টাকা। আউশ বীজতলার প্রায় ৪২ ভাগ, রোপা আউশের ২২ ভাগ এবং মাঠে দন্ডায়মান তিল-এর পুরোটাই বিনষ্ট হয়েছে। কলা ও কাঁচা পেরে ক্ষতিও ব্যাপক। পান বরজের ক্ষতির হার ৩২ ভাগ। আক্রান্ত মরিচের প্রায় ৮৪ ভাগই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে।
অপরদিকে মৎষ্য খাতের ক্ষতিও ব্যাপক। এ অঞ্চলের প্রায় ৮৭ হাজার পুকুর ও ৭হাজার ঘের’এর মাছ রিমেল-এর ঝড়-জলোচ্ছাসে ভেসে গেছে। এছাড়া ১২০টি কাঁকড়া ও কুচিয়ার খামারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পুকুর, ঘের ও খামার প্লাবিত হওয়ায় প্রায় ৭ হাজার ১শ টন মাছ, ১৬০ টন চিংড়ি,৭শ টনের মত পোনা মাছ, ৭০ টনের মত কাঁকড়া ও কুচিয়া ভাসিয়ে নেয়ে গেছে রিমেল-এর বয়ে আনা জলোচ্ছাসে। ঝড়ের কারণে অন্তত ৪০ জন জেলে আহত হওয়া ছাড়াও ৩১টি মাছ ধরা নৌকা ও ট্রলার এবং প্রায় ৯শ জাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৎস্য অধিধপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় দপ্তরের মতে প্রাথমিকভাবে মৎস্য সেক্টরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান প্রায় ২১৮ কোটি টাকা।
অপরদিকে প্রাণিসম্পদ খাতেও ক্ষতির পরিমান ব্যাপক। উপকূলের বিচ্ছিন্ন চরগুলোর বিপুল সংখ্যক গরু-মহিষ সাগরের জোয়ার আর প্রবল বর্ষণের পানিতে জীবন মরনের লড়াইয়ে ছিল। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসেবে বরিশাল অঞ্চলের ১৪১টি ইউনিয়নের গবাদিপশু ঘূর্ণিঝড়-এর দুর্যোগ কবলিত। এসব এলাকার প্রায় আড়াই হাজার গরু ও মহিষ ছাড়াও প্রায় দেড় হাজার ছাগল, শতাধিক ভেড়া ও ৩০ হাজার হাঁস-মুরগী রিমেল-এর দুর্যোগ কবলিত। এছাড়াও এ অঞ্চলের বানিজ্যিক ভিত্তিতে যে ২ হাজার ৭১ টি লেয়ার, সাড়ে ৪ হাজারের মত ব্রয়লার ও প্রায় আড়াই হাজার সোনালী মুরগীর খামার রয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই কমবেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অধিদপ্তর থেকে প্রাথমিকভাবে ক্ষতির পরিমান কয়েক কোটি টাকা বলে প্রাথমিকভাবে হিসেব করা হলেও আজকালের মধ্যেই পরিপূর্ণ পরিসংখ্যান তৈরী সম্ভব হবে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত উপকূলীয় বনভূমি রুখে দিলেও সেখাতেও ক্ষতি ব্যাপক। প্রায় আড়াইলাখ হেক্টর বনভূমি ঘূর্ণিঝড় রিমেল’কে রুখে দিতে প্রাণপন চেষ্টা করলেও ঝড়ে বিশাল বনভূমীর ব্যপক ক্ষতি হয়েছে। বরিশাল উপকূলজুড়ে কয়েক লাখ সরকারি-বেসরকারী গাছ মাটিতে মিশে গেছে। বন অধিধপ্তরের বরিশাল কোষ্টাল সার্কেলের প্রাথমিক হিসেবে উপকূলীয় এলাকার প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও সৃজিত বন বাগানের যে ক্ষতি হয়েছে, আর্থিক হিসেবে তার ক্ষতির পরিমান প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। এসব এলাকায় নার্সারীর বিপুল সংখ্যক চারাও ব্যাপক ক্ষতির কবলে।
তবে এসব কিছুর বাইরে পল্লী যোগাযোগ অবকাঠামো এবং সড়ক অধিদপ্তরের সড়ক ও মহাসড়ক ছাড়াও বিভিন্ন অবকাঠামো ও বিদ্যুৎ খাতেও ক্ষতি ব্যাপক। বরিশালের ৬টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রায় ২২ লাখ ১০ হাজার গ্রাহকের সাড়ে ১২ লাখই রিমেল-এর তান্ডবে বিদ্যুৎ শূন্য হয়ে পড়েছে। এছাড়া পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানী-ওজোপাডিকো’র আরো সোয়া ৩লাখ গ্রাহকের অন্তত ৩ লাখই রোববার রাতে বিদ্যুৎ সংযোগ হারায়। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পল্লী বিদ্যুতের প্রায় অর্ধেক এবং ওজোপাডিকো’র ৭০ ভাগ গ্রাহক বিদ্যুৎ সংযোগের আওতায় এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দাবী করলেও এখনো বিপুল সংখক মানুষ অন্ধকারে। বিদ্যুতের অভাবে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সহ পানি সরবরাহ বিপর্যস্ত। ফলে পানি, বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগের অভাবে গত রোববার রাত থেকে বরিশাল অঞ্চলে চরম মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে।