শ্রান্তি বিনোদনের ভরসাস্থল বঙ্গবন্ধু উদ্যানটি অশ^স্তির জায়গায় পরিনত হয়েছে শ্রান্তি বিনোদনের ভরসাস্থল বঙ্গবন্ধু উদ্যানটি অশ^স্তির জায়গায় পরিনত হয়েছে - ajkerparibartan.com
শ্রান্তি বিনোদনের ভরসাস্থল বঙ্গবন্ধু উদ্যানটি অশ^স্তির জায়গায় পরিনত হয়েছে

4:25 pm , May 25, 2024

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশাল মহানগরীর শ্রান্তি বিনোদনের অন্যতম ভরসাস্থল ‘বঙ্গবন্ধু উদ্যানটি ক্রমশ বেদখল হয়ে যাচ্ছে। উদ্যানটির সার্বিক পরিবেশ এবং রক্ষনাবেক্ষন ও উন্নয়ন নিয়ে অসন্তুষ্ট নগরবাসীর মনে নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রাত ও বৈকালিন ভ্রমণকারী সহ নগরীর সাধারন মানুষ একটু শ্রান্তি খুঁজতে ঐতিহ্যবাহী এ উদ্যানে গিয়ে প্রায়শই চরম অস্বস্তির শিকার হচ্ছেন। পথ খাবারের দোকান থেকে নানা ধরনের দোকানের পসরা সাজিয়ে উদ্যানের অভ্যন্তরের পরিবেশও এখন বিপন্ন। ফেরিওয়ালা ও ভিক্ষুক এর  উৎপাতের সাথে কিশোর গ্যাং এর সংগঠিত ও অসংগঠিত মাস্তান বাহিনীর নানামুখি তৎপরতায় ঐতিহ্যবাহী বঙ্গবন্ধু উদ্যানটি তার অতীত ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। বাড়ছে সাধারন মানুষের হতাশার সাথে ক্ষোভের পরিধিও।
ইতোমধ্যে অসংখ্য পথ খাবারের দোকানের সাথে কিশোর গ্যাং ও বিবেকহীন কতিপয় মানুষের নানা অনৈতিক কর্মকান্ডে বঙ্গবন্ধু উদ্যানজুড়ে সুস্থ সামাজিক পরিবেশ মারাত্মক বিপন্ন। ইতোপূর্বে উদ্যানটির উত্তর প্রান্তের রাস্তার ধারের পথ খাবারের দোকান এখন পুরো রাস্তা থেকে শুরু করে মাঠে প্রবেশের সব ফাঁক-ফোকরও দখল নিয়েছে। মাঠটির উত্তর প্রান্ত দিয়ে প্রবেশের সব সুযোগই প্রায় রুদ্ধ করার পরে পশ্চিম প্রান্তের একমাত্র প্রবেশ পথটিও আটকে দোকান বসানো হয়েছে। সাম্প্রতিককালে মাঠের অভ্যন্তর ভাগেও বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট দখল নিতে শুরু করেছে। ঝালমুড়ি, আচার, সরবত আর বিভিন্ন কাটা ফলের দোকানের সাথে বিভিন্ন হস্তশিল্প ও পুরনো ব্যাগের দোকান ক্রমে বঙ্গবন্ধু উদ্যানের অভ্যন্তর ভাগও দখল নিচ্ছে। কিন্তু এসব অনিয়ম দেখার কেউ নেই।
পথ খাবারের দোকানের নানা বর্জ্য সহ গরম পানিও মাঠের অভ্যন্তর সহ পাশের ডিসি লেকে ফেলায় প্রায়ই লেকটির পানি দূষিত হয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়। মাঠের অভ্যন্তরের অনেক স্থানের ঘাস মরে যাবার পরে তা আর গজাচ্ছে না। এসব পথ খাবারের দোকানের বর্জ্য সহ গরম পানির কারণে গত বছর মাঠের উত্তর প্রান্তে শতাধিক বছরের প্রাচীন বিশাল রেইন্ট্রি গাছটির মৃত্যু হয়েছে। গণপূর্ত অধিদপ্তরের এ বিশাল ময়দানটি রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে নানা অবকাঠামো বিনষ্ট হচ্ছে। নগর ভবন থেকে তিন দফায় বিপুল অর্থ ব্যয়ে পুরো মাঠ আলোকিত করা হলেও এখন সেখানে সন্ধ্যার পরে অনেক বাতিই আলো ছড়ায় না। এ উদ্যানটির দেখভালের কেউ আছে বলেও দৃশ্যমান নয়।
বৃটিশ আমলে বর্তমান বরিশাল এবং তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার জেলা ম্যজিস্ট্রেট ‘মিঃ বেল’ প্রায় পৌনে ৯ একর সরকারি খাস জমির উপর এ উদ্যানটি গড়ে তোলেন। তখন তার নাম অনুসারে উদ্যানটির নামকরন হয় ‘বেল পার্ক’। গণপূর্ত বিভাগ এ পার্কটির মালিকানা সহ এর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব লাভ করলেও বছর কয়েক আগে উদ্যানটির দুই দিকে জেলা প্রশাসন থেকে নকশা খচিত বিশাল প্রস্তর খন্ডে ভূমির মালিক ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ ময়দানের উন্নয়ন ও রক্ষনাবেক্ষনে জেলা প্রশাসনের কোন ভূমিকা নেই।
১৯৭৩ সালের ৩ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বরিশাল সফরকালে একটি সুন্দর নান্দনিক উদ্যান গড়ে তোলার লক্ষ্যে ‘বঙ্গবন্ধু উদ্যান এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। সেই থেকে বেল পার্কের সাথে এ উদ্যানটি বঙ্গবন্ধু উদ্যান নামেও পরিচিত লাভ করে। ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু উদ্যানে ইতোপূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমানী, সংবিধান প্রনেতা ড. কামাল হোসেন ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদ সহ বিভিন্ন জাতীয় নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রেখেছেন।
২০০৪ সালে তৎকালীন সিটি মেয়র মজিবর রহমান সারোয়ারের উদ্যোগে সরকারি প্রায় ৩ কোটি টাকায় গণপূর্ত অধিধপ্তরের মাধ্যমে প্রথম উদ্যানটির চারিধারে ওয়াকওয়ে, বসার বেঞ্চ এবং ছাতা সহ শৌচাগার ও বিশ্রামাগার নির্মান সহ পুরো উদ্যানটিজুড়ে দৃষ্টিনন্দন বাতি লাগান হয়। পাশাপাশি শোভাবর্ধনের জন্য পুরো মাঠের ওয়াকওয়ের মাঝে এবং চারপাশে গাছও লাগান হয়েছিল। সেই থেকে উদ্যানটির পরিচ্ছন্নতা ও রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন। প্রতিদিনই নগরীর বিপুল সংখ্যক মানুষ এ উদ্যানে সকাল-বিকেল হাটতে ও শ্রান্তি বিনোদনের জন্য আসেন। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরে অজ্ঞাত কারণে এখান থেকে সব ‘গার্ডেন লাইট’ খুলে নেয়ায় ভূতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ২০১১ সালে তৎকালীন সিটি মেয়র শওকত হোসেন হিরণ তহবিল সংগ্রহ করে গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে উদ্যানটিতে দ্বিতীয় ওয়াকওয়ে নির্মান সহ পূর্ব পাশের্^ বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপন করেন। পাশাপাশি উদ্যানটির পূর্বপাশের নালাটি সংস্কার করে সেখানে শাপলার আবাদ ছাড়াও সংলগ্ন বাঁধরোডে পাকা ফুটপাথ নির্মান সহ সোনালু গাছ লাগান হয়। যা এখনো নগরবাসীর চোখ জুড়ায়।
দ্বিতীয় দফায় সংস্কারের পরে উদ্যানে প্রাত ও বৈকালিন ভ্রমনকারীর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেলেও গত কয়েক বছর ধরে ভ্রমনকারীর চেয়ে আড্ডাবাজদের ভীড় বেশী। সাথে দিনরাত উদ্যানটির পুরো এলাকা কিশোর গ্যাং এর দখলে। উদ্যানটি জুড়ে নানা ধরনের পথ খাবারের দোকান আড্ডাবাজদের জন্য বাড়তি সুবিধা সৃষ্টি করছে।
পুরো বঙ্গবন্ধু উদ্যানের মেরামত ও রক্ষনাবেক্ষনে গত কয়েক বছর ধরে গণপূর্ত বিভাগ ও নগর ভবনের ন্যূনতম কোন উদ্যোগ নেই। শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী যখন এ ময়দানে কোন কর্মসূচীতে আসেন, তখনই গণপূর্ত অধিদপ্তর একটু নড়েচড়ে বসে। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী ও গেলো বছরের ২৯ জানুয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ময়দানে জনসভায় ভাষণ দেয়ার আগে তড়িঘড়ি করে উদ্যানটির জরুরী সংস্কার করা হয়। তবে ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু উদ্যানের দক্ষিণ ও পশ্চিম পাড়ের গ্রীলের বেশীরভাগই দেয়াল থেকে খসে পড়ার পর চুরি হয়ে গেছে।
গত কয়েক বছর ধরে উদ্যানটির উত্তর প্রান্তে বৃক্ষমেলা আয়োজন করতে গিয়ে অপরিকল্পিতভাবে বালু ফেলায় রাস্তা থেকে মাঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই ওয়াকওয়ে ডুবে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ওয়াকওয়ের অসংখ্য সিরামিক ইট চুরি হয়ে গেছে। কিন্তু এসব বিষয় দেখার কেউ নেই। সিটি করপোরেশনের কয়েকজন শ্রমিক নামকাওয়াস্তে ওয়াকওয়ে ঝাড়ু দেয়া ছাড়া নগর ভবনের কাউকে এখানে দেখা যায়না।
উদ্যানের অভ্যন্তরে এখন আগের সুস্থ সামাজিক পরিবেশ অনেকটাই বিপন্ন। উদ্যানটির ওয়াকওয়েতে নারী-পুরষ এখন আর নির্বিঘেœ, নির্ভরতার সাথে হাটতে আস্থা রাখতে পারছেন না। প্রতিদিনই বিপুল সংখ্যক বখাটে ও স্কুল-কলেজ পড়–য়া ছেলে-মেয়েদের গভীর রাত পর্যন্ত অনৈতিক বিচরনে গোটা উদ্যানটির পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। পড়ার টেবিল ছেড়ে গভীর রাত পর্যন্ত কতিপয় ছাত্র-ছাত্রীর অনৈতিক বিচরনে উদ্যানের সামাজিক পরিবেশ বিপন্ন হলেও তা দেখার কেউ নেই। কিশোর গ্যাং এর তৎপরতায় বঙ্গবন্ধু উদানের সামাজিক পরিবেশ বিপর্যস্ত। মাস কয়েক আগে এসব কিশোর গ্যাং-এর হাতে এক ট্রাফিক সার্জেন্টের স্ত্রী শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন। অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় এক কাউন্সিল-এর ঘনিষ্ঠজন বঙ্গবন্ধু উদ্যানের পথ খাবার থেকে শুরু করে সব ধরনের অবৈধ দোকানপাট ও কিশোর গ্যাংকে নিয়ন্ত্রন ও পরিচালন করছেন।
বরিশাল মহানগরীর হ্রদস্পন্দন এ বঙ্গবন্ধু উদ্যানেই প্রতিবছর ‘বৃক্ষ মেলা’য় বিভাগ ও জেলার শীর্ষ কর্মকর্তা সহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও পরিবেশের ওপর অনেক ভাল কথা বলেন। কিন্তু সেই মেলা করতে গিয়ে এ উদ্যানটির নাড়ী চেপে ধরা হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে অপরিকল্পিত বালু ফেলে বঙ্গবন্ধু উদানের যে সর্বনাশ করা হয়েছে, তা থেকে উত্তরণের কোন উদ্যোগ নেই। গত কয়েক বছরে বঙ্গবন্ধু উদ্যান ও সংলগ্ন সড়ক থেকে অনেক গাছ বিলুপ্ত হলেও কেউ নতুন করে একটি গাছও রোপন করেননি। এ ব্যাপারে গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে আলাপ করা হলে তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু উদ্যানকে আরো সুন্দর ও জনবান্ধব করার ক্ষেত্রে তিনি সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। তবে উদ্যানটির পরিচ্ছন্নতার কাজটি সিটি করপোরেশন করে থাকে। বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সেল ফোনে যোগাযোগের বহু চেষ্টা করে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT