4:10 pm , May 19, 2024

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ রক্ষা সহ উন্নয়নে দেশের সমুদ্র এলাকায় আজ থেকে ৬৫ দিনের মৎস্য আহরণ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে। তবে মৎস্য বিজ্ঞানীরা প্রতিবেশী দেশের সাথে সমতা রেখে সাগরে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধের সময় পুণঃবিবেচনার কথা বলে আসছেন। ভারতে সর্বপ্রথমে ১৯৮৮ সালে ১৫ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সমুদ্রে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ থাকলেও ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশ সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের সাগর এলাকায় ১৫ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে। মিয়ানমারেও জুন থেকে আগষ্ট পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে। যার কোনটিই আমাদের সাথে পরিপূর্ণ সংগতিপূর্ণ নয়। ফলে বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় মৎস্য আহরণে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে ভারত ও মায়ানমারের জেলেরা আমাদের একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবৈধ প্রবেশ করে মাছ ধরে নিয়ে যাবার অভিযোগ রয়েছে। আহরণ নিষিদ্ধকালীন এ সময়ে উপকূলভাগের বাইরে সাগর এলাকায় কোন ধরনের সামুদ্রিক ট্রলার সহ মাছ ধরা নৌকার পরিচালন ও বিচরনও নিষিদ্ধ থাকছে। বিষয়টি নিশ্চিত করণে মৎস্য অধিদপ্তর নৌপুলিশ, কোষ্ট গার্ড, র্যাব ও নৌ বাহিনী সহ বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় অভিযান পরিচালনার কথাও জানিয়েছে। তবে এ লক্ষে মাঠ পর্যায়ে রোববার পর্যন্ত তেমন কোন প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি উপকূলীয় জেলা ও উপজেলাগুলোতে নৌ পুলিশ ও মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে নিরাপদ কোন নৌযানও নেই। তবে এর পরেও ৬৫ দিনের এ নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে আহরণ শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে সম্ভব সব পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়েছেন মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশালের বিভাগীয় উপ পরিচালক।
এদিকে ৬৫ দিনের এ নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে মৎস্য আহরণে বিরত জেলেদের খাদ্য নিরাপত্তায় এবারো সরকার উপকূলের ১৪ জেলার ৬৮ উপজেলায় ৩ লাখ ১১ হাজার ৬২ জেলে পরিবারকে মাথাপিছু মাসিক ৪০ কেজি হিসেবে ৪২ দিনের জন্য পরিবার প্রতি ৫৬ কেজি করে সর্বমোট ১৭ হাজার ৪১৯ টন চাল বিতরণ করবে। যারমধ্যে শুধু বরিশাল বিভাগের ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৯ জেলে পরিবারের ৮ হাজার ১৭৭ টন খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ রয়েছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমানা জুড়ে বিস্তীর্ণ জলরাশির সঞ্চালন সুনীল ঢেউ-এর মাথায় যে রূপালী উর্মিমালা আলিঙ্গন করছে, বিশ্ব মানচিত্রে তা-ই বঙ্গোপসাগর। পৃথিবীর অন্য সব সাগরের মতই প্রকৃতির সব লীলার সঙ্গিনী হয়ে মেতে আছে আমাদের অবিচ্ছেদ্য বঙ্গোপসাগরও।
সরকার বঙ্গাপসাগরে দেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০ মে মধ্যরাত থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সব ধরনের বানিজ্যিক মাছধরা নৌযানে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করায় গত কয়েক বছরে সামুদ্রিক মাছের উৎপাদন প্রায় এক লাখ টন বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের মৎস্য সম্পদে সামুদ্রিক মাছের অবদান প্রায় ৮Ñ১০%। বঙ্গোপসাগরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সহ চিংড়ির প্রজনন প্রক্রিয়া নিরাপদ ও নিশ্চিত করণ এবং আহরণ প্রবৃদ্ধি টেকসই করতেই ২০১৫ থেকে ’১৮ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ট্রলারের ক্ষেত্রে এবং ২০১৯ সাল থেকে সব মৎস্য নৌযানের ক্ষেত্রেই ৬৫ দিনের আহরণ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জেলে ও মৎস্যজীবীদের মধ্যে কিছুটা বিরূপ মনোভাব থাকলেও দেশের মৎস্য সম্পদকে সমৃদ্ধ করা সহ জেলে ও মৎস্যজীবিদের ভবিষ্যত জীবন-জীবিকা নিরাপদ করতে এ পদক্ষেপকে ‘বিজ্ঞান সম্মত’ বলেই মনে করছেন মৎস্য বিজ্ঞানীরা।
মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, বিভিন্ন বৈশিষ্ট ও বৈচিত্রপূর্ণ মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বিশে^র একমাত্র উপসাগর যেখানে সবচেয়ে বেশী নদী বিধৌত পানি প্রবেশ করে। দক্ষিণ-পশ্চিমের সাতক্ষীরা থেকে পূর্ব-দক্ষিণের টেকনাফ পর্যন্ত ৭১০ কিলোমিটার উপকূলীয় তটরেখা এবং সমুদ্রের ২শ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত ‘একান্ত অর্থনৈতিক এলাকার পরিমান ১ লাখ ১৮ হজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার। ছোট-বড় নানা আকার-প্রকারের ৪৭৫ প্রজাতির মাছ ছাড়াও ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া, ৫ প্রজাতির কচ্ছপ ও ১৩ প্রজাতির প্রবাল সহ বিভিন্ন জলজ সম্পদে সমৃদ্ধ আমাদের সমুদ্র এলাকা। বঙ্গোপসাগরে আমাদের একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে বর্তমানে ৩২টি চিংড়ি ট্রলার, ১৯৯টি মৎস্য ট্রলার ছাড়াও প্রায় ৩৩ হাজার যন্ত্রচালিত মৎস্য আহরণ নৌযান ও প্রায় ৩৫ হাজার পালতোলা নৌযান নিবন্ধিত বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।
কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিশ^ব্যাপী সামুদ্রিক ও উপকূলীয় মৎস্য সম্পদ অতি আহরণ জনিত ক্রমহ্রাসমানতা, ভূমি ও সমুদ্র হতে সৃষ্ট দুষণ এবং জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন সহ নানামুখি সংকটে বঙ্গোপসাগর। ফলে মৎস্যকুলের প্রাচুর্য, বিস্তৃতি ও প্রজাতির ওপর বিরূপ প্রভাবও ক্রমশ বাড়ছে। আমাদের সমুদ্রিক ও উপকূলীয় মৎস্য স¤পদও এ বিরূপ প্রভাবের কবলে।
মৎস্য বিজ্ঞানীরা বিশাল এলাকার জলরাশির মৎস্য সম্পদ সংরক্ষন, ব্যবস্থাপনা এবং সুষ্ঠু ও বিজ্ঞানসম্মত সহনশীল আহরণ নিশ্চিত করে বছরের পর বছর সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন অব্যাহত সহ বংশ বৃদ্ধি ও মজুত অক্ষুন্ন রাখার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে এক্ষেত্রেও বিজ্ঞানীরা আমাদের একান্ত বাস্তবতা ও পরিবেশকে বিবেচনায় নিয়ে সামুদ্রিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা নীতি ও কৌশল প্রণয়ন অত্যাবশ্যক বলে মনে করছেন।
সমুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা ১৯৮৩-এর ১৯ নম্বর বিধি অনুযায়ী মৎস্য আহরণ প্রবৃদ্ধি টেকসই করার লক্ষে প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত এ আহরণ নিষিদ্ধ করা হচ্ছে । এছাড়াও প্রতিবছর আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে-পরের ২২ দিন উপকূলের ৭ হাজার ৩৪৪ বর্গ কিলোমিটারে মূল প্রজনন ক্ষেত্রে সব ধরনের মৎস্য আহরণ সহ দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নদ-নদীতে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ থাকছে। ফলে গত দুই দশকে জাতীয় এ মাছের উৎপাদনও প্রায় তিনগুন বৃদ্ধি পেয়েছে।
কিন্তু ঝড়Ñঝঞ্ঝার মৌসুমে সাগরে ৬৫ দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষনার বিষয়টি নিয়ে উপকূলের জেলে ও মৎস্যজীবিদের মাঝে যথেষ্ট বিরূপ মনোভাব রয়েছে। জেলে ও মৎস্যজীবিদের অভিযোগ, বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও এসময়ে ভারতে নিষিদ্ধ না থাকায় সে দেশের জেলেরা অবাধে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে মাছ লুটে নিচ্ছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বন্ধ মৌসুম কার্যকর হবার আগে ও পরে আহরিত মাছের ক্যাচলগ পর্যালোচনায় মৎস্য আহরণের পরিমান বৃদ্ধির সুস্পষ্ট প্রবনতা লক্ষ্য করা গেছে। এ ব্যাপারে দেশের বিশিষ্ট মৎস্য বিজ্ঞানী ও মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক(সামুদ্রিক) ড. মোঃ আবুল হাসনাত জানান, নির্দিষ্ট সময়ে মাছধরা বন্ধ রাখা সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের কার্যকরি ব্যবস্থাপনার একটি সহজ ও অত্যন্ত ফলদায়ক পদ্ধতি।
এদিকে মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানেও আহরণে নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের পরের বছরগুলোতে সাগরে মাছের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে দেশে উৎপাদিত ৪৩ লাখ ৮৪ হাজার টন মাছের মধ্যে সামুদ্রিক এলাকায় উৎপাদন ছিল প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার টন। যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ লাখ টন অতিক্রম করে। সাম্প্রতিক বছরে ১লাখ টন মাছ রপ্তানি করে দেশ যে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে, তারমধ্যে সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের অবদানও ব্যাপক বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।