4:19 pm , May 13, 2024

এসএসসি পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে জিপিএ-৫
নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ দীর্ঘ পাঁচ বছর ক্যান্সারের সাথে লড়াই করার পরও দমানো যায়নি বরিশাল জিলাস্কুলের শিক্ষার্থী মাহাথির রহমানকে। এ বছর প্রতিটি বিষয়ে জিপিএ-৫ নিয়ে পাস করেছে। ভবিষ্যতে ক্যান্সারের মানবিক চিকিৎসক হতে চায় মাহাথির। আর তাকে উৎসাহ জোগাচ্ছেন তার মা-বাবা এবং আত্মীয়স্বজন।
মাহাথিরের বাবা প্রবাসী মোহাম্মদ মফিজুর রহমান বলেন, তিনি দীর্ঘ ২২ বছর ধরে আবুধাবীতে কর্মরত ছিলেন। তার জমজ দুই সন্তান মাহাথির রহমান ও মাকতুম রহমান বরিশাল নগরীর মুন্সি গ্যারেজ এলাকায় তাদের মায়ের কাছে থাকতো। ২০১৮ সালের দিকে মাহাথির তার মায়ের সাথে বাজারে যায়। এ সময় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বরিশালের চিকিৎসকরা নানা ধরনের পরীক্ষা শেষে ছেলেকে ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেন। পরবর্তীতে তাদের চিকিৎসক আত্মীয়ের শরনাপন্ন হন তার স্ত্রী। সেখান থেকেও একই ফলাফল আসে। তার বোন ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। পরবর্তীতে বিষয়টি তাকে জানানোর পর বিদেশে বসে ছেলের চিন্তায় ভেঙ্গে পড়েন। সেখানে যে কোম্পানীর অধীন চাকরিতে ছিলেন তাদের কাছে পাসপোর্ট জমা ছিল। পরবর্তীতে ওই কোম্পানীকে বিষয়টি বুঝিয়ে পাসপোর্ট আনতে কিছু সময় চলে যায়। এরপর দেশে এসে ছেলেকে নিয়ে যান ভারতে। সেখানে চলে দীর্ঘ ছয়মাসের চিকিৎসা।
মফিজুর রহমান আরো বলেন, ছোটবেলা থেকে মাহাথিরের লেখাপড়ায় ঝোক ছিল। একই অবস্থা ছিল তার অপর জমজ সন্তানের। অসুস্থ হওয়ার পরও সে কোনভাবেই লেখাপড়া থেকে দূরে সরে যায়নি। সুস্থতা অনুভব করলেই বই হাতে নিয়ে পড়তে বসতো। তাকে লেখাপড়ায় কোনভাবে জোর করা হতো না। এভাবে দীর্ঘ ৫ বছর মাহাথিরকে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এরপর বোন মেরু ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২টি বিভিন্ন ওষুধ খেতে হয়। তাছাড়া দীর্ঘ চিকিৎসায় তাকে অর্ধশতাধিক কেমো দিতে হয়েছে। খাবারের প্রতি সামান্যতম আসক্তি ছিল না। এভাবে চলতে থাকায় ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বিদেশে যাওয়া আর হয়নি। আল্লাহর দরবারে একটি ফরিয়াদ মাহাথির সুস্থ জীবনে ফিরে আসুক।
মাহাথিরের বাবা বলেন, অসুস্থ শরীর নিয়ে ২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে পরীক্ষা থেকে বিরত থাকতে হয়। কিন্তু সুস্থ অনুভব করলেই মাহাথির বই এর মধ্যে ডুবে থাকতো। তখন তাকে নিষেধ করলেও তা শুনতো না। তার কথা ছিল আমি এখন সুস্থ আছি কিছু লেখাপড়া করে এগিয়ে থাকি। এভাবে চলতে থাকার পর ২০২৪ সালের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয় মাহাথির। এ জন্য বাসায় শিক্ষক রেখে দেয়া হয়।
মাহাথিরের জমজ ভাই মাকতুম রহমান বলেন, তারা জমজ হওয়ায় একই সাথে প্রতিটি ক্লাসে অধ্যায়ন করেছে। তারা দুইজনই মেধাবী। প্রতিটি ক্লাসে ভালো ফলাফল করতো তারা। কিন্তু মাহাথির অসুস্থ হয়ে পড়লে তার প্রভাব পড়ে তার উপর। কারন বেশীরভাগ সময় বাবা-মা মাহাথিরকে নিয়ে ঢাকা ও ভারতে অবস্থান করতো। ওই সময় আত্মীয়স্বজনের কাছেই তাকে থাকতে হয়েছে। কিন্তু এরপরও লেখাপড়া থেকে সরে যায়নি। ২০২২ সালে বরিশাল জিলাস্কুল থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। বর্তমানে সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেবে। তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার আশা রয়েছে। একই সাথে তার ভাই মাহাথিরের চিকিৎসক হওয়ার আশা পূরন হবে বলে আশাবাদী মাকতুম। কারন মাহাথির তার চেয়েও অনেক মেধাবী। পিছয়ে পড়লেও মাহাথির তার টার্গেট পূরন করবেই। মাহাথিরের মা হোসনে আরা বেগম বলেন, তার জমজ সন্তান দুটি মেধাবী। তারা বেশীরভাগ সময় পড়ালেখায় ব্যস্ত সময় কাটায়। তাদেরকে পড়ার জন্য বলার প্রয়োজন হয় না। মাহাথির চিকিৎসাধীন অবস্থায় বই নিয়ে পড়াশুনা করতো। তার শরীর ভালো থাকলেই কোনভাবে তাকে আটকানো যেতো না। আর এ কারনেই এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই মাহাতির বলতো সে ডাক্তার হবে। অসুস্থ হওয়ার পর সেই আবেগটা তার মধ্যে বেশী কাজ করছে। কারন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কষ্টটা অনুভবন করতে পেরেছে। এ কারনে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হতে চায় মাহাথির। আমাদেরও ইচ্ছা মাহাথির তার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিক। একই সাথে একজন মানবিক চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করুক। এ জন্য মা-বাবা হিসেবে আমরা দুইজন সর্বাত্মক তার পাশে থাকবো।মাহাথির রহমান বলেন, ক্যান্সারের বিষয়টি ধরা পড়ার পর দীর্ঘ ৫ বছর তার চিকিৎসা চলে। এর মধ্যে ঢাকা এবং ভারতে বেশীরভাগ সময় কাটাতে হয়েছে। ওই দুই স্থানের চিকিৎসকরা তাকে অনেক সাহায্য করেছে। তাদের সাথে মেইলে তার রোগের বিষয়ে কথা হতো। তাদের চিকিৎসা এবং উৎসাহ তাকে দ্রুত সুস্থতা এনে দিয়েছে। বই পড়ার তার শখ এবং নেশা। এ কারনে ছোটবেলা থেকেই ক্লাশের বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে তার ভালো লাগতো। অসুস্থ হওয়ার পর তাতে ভাটা পড়ে। কিন্তু সুস্থতা অনুভব করলেই বই নিয়ে বসে যেতো। ২০২৩ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে চেয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসকের নিষেধের কারনে অংশ নেয়নি। পরবর্তীতে ২০২৪ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। বাসায় শিক্ষক এবং মা-বাবার সহযোগিতায় তার ভালো ফলাফল হয়েছে বলে দাবি মাহাথিরের। ভবিষ্যতে একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ হতে চায় মাহাথির। কারন এ রোগ মানুষকে কতটা কষ্ট দে তা নিজ থেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছে। সে একজন মানবিক চিকিৎসক হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আগামীতে এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে দেশের যে কোন মেডিকেলে চান্স পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। এ জন্য সকলের দোয়া চায় মাহাথির।
বরিশাল জিলাস্কুলের প্রধানশিক্ষক পাপিয়া জেসমিন বলেন, মাহাথির এবং মাকতুম জমজ দুই ভাই খুবই মেধাবী। তবে তার দৃষ্টিতে বেশী মেধাবী মাহাথির। কারন ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন শিক্ষার্থী ওই অবস্থায় লেখাপড়া করে প্রতিটি বিষয়ে জিপিএ-৫ পাওয়া সহজ নয়। মাহাথিরের সুস্থ হয়ে যেন একজন মানবিক চিকিৎসক হতে পারে এ জন্য সকলের কাছে দোয়া চান তিনি।