অব্যাহত তাপ প্রবাহে বরিশালে জনস্বাস্থ্যের সাথে কৃষি, মৎস্য ও প্রণি সম্পদ খাতের বিপর্যয় অব্যাহত তাপ প্রবাহে বরিশালে জনস্বাস্থ্যের সাথে কৃষি, মৎস্য ও প্রণি সম্পদ খাতের বিপর্যয় - ajkerparibartan.com
অব্যাহত তাপ প্রবাহে বরিশালে জনস্বাস্থ্যের সাথে কৃষি, মৎস্য ও প্রণি সম্পদ খাতের বিপর্যয়

4:13 pm , May 4, 2024

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশালে নজিরবিহীন লাগাতার তাপ প্রবাহের রেকর্ডের মধ্যে বৃষ্টির আকালে জনস্বাস্থ্যের পাশাপাশি কৃষি,মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ খাতে ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হচ্ছে। তাপমাত্রার পারদ ইতোমধ্যে স্বাভাবিকের ৬ডিগ্রী ওপরে উঠে যাবার মধ্যে এপ্রিল মাসে বরিশালে বৃষ্টিপাতের পরিমান ছিল ৮৬% কম। মার্চ মাসে ৩০% কম বৃষ্টি হয়েছে। এমনকি চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমান স্বাভাবিকের অনেক নিচে। প্রকৃতির এ বিরূপ আচরনে বরিশাল সহ সন্নিহিত এলাকায় স্বাভাবিক জনজীবনে বিপর্যয়ের পাশাপাশি জলবায়ুর পরিবর্তন সুস্পষ্ট। ডায়রিয়া ও পেটের পীড়া সহ নানা ধরনের রোগ ব্যাধির বিস্তার উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। গত এপ্রিল মাসে বরিশালের সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায় ১২ হাজার ডায়রিয়া রোগী চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন। আর চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩২ হাজার। তবে এর তিনগুনেরও বেশী রোগী সরকারি হাসপাতালের বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রতিদিনই গড়ে ৫ শতাধিক ডায়রিয়া রোগী সরকারি হাসপাতালে আসছে।
সাথে কৃষি,মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ খাতও মারাত্মক ঝুঁকির মুখে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সদ্য সমাপ্ত এপ্রিল মাসে বরিশালে সর্বোচ্চ স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৩.৪ ডিগ্রীর স্থলে পারদ ৩৯.২ ডিগ্রী ছুঁয়েছে। চলতি মে মাসে স্বাভাবিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রী থাকার কথা বলে আবহাওয়া বিভাগ জানালেও ইতোমধ্যে তা ৩৮ ডিগ্রীর ওপরে উঠে গেছে। তবে শনিবার দুপুর ৩টায় বরিশালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রীর কিছু ওপরে ছিল।
এপ্রিলের শুরু থেকেই বরিশালে তাপমাত্রার পারদ ক্রমশ ওপরে উঠতে শুরু করে। যা গত ২২ এপ্রিল ৩৯.২ ডিগ্রীতে পৌঁছে। নজিরবিহীন লাগাতার এ তাপ প্রবাহে বরিশালে মানুষের সুস্থ জীবন ব্যবস্থা প্রায় বিপর্যস্ত। অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজন ছাড়া দুপুর ১২টার পরে বেশীরভাগ মানুষ ঘর থেকে বের না হলেও শ্রমজীবী ও কর্মজীবী মানুষের দুর্ভোগ আরো বেশী। কাজ না করলে পেট চলবে কিভাবে, সে উত্তর খুঁজতে কাজে নামতে গিয়ে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। অথচ এসময়ে বোরোর জমিতে বিশেষ পরিচর্জা জরুরী। উপরন্তু আউশের বীজতলা তৈরীর সময়ও প্রায় শেষ হয়ে আসছে। কিন্তু  বৃষ্টির অভাবের সাথে অব্যাহত তাপ প্রবাহে কৃষি শ্রমিকদের মাঠে নামতে না পারায় কৃষি ক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। ফলে দেশের ৩৫ ভাগ আউশ উৎপাদনকারী বরিশাল অঞ্চলে এবার এ ধানের আবাদ নিয়ে সংশয় বাড়ছে।
বরিশাল কৃষি অঞ্চলে প্রায় ১৮ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যে যে ৪ লাখ হেক্টরে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে, সে ধানে এখন ফুল থেকে দুধ’ও তৈরী হয়েছে। এসময়ে নিয়মিত সেচ প্রয়োগ সহ নিবিড় পরিচর্যা এবং সার্বক্ষনিক নজরদারী প্রয়োজন বোরো ধানের জমিতে। কিন্তু গত প্রায় ২০-২৫ দিনের অব্যাহত তাপ প্রবাহে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপন্ন হবার সাথে কৃষি সেক্টরে ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বরিশাল অঞ্চলে পর্যায়ক্রমে বোরো ধান কর্তন শুরু হবে। কিন্তু বৃষ্টির অভাবে বাড়তি সেচ দিতে গিয়ে এবার ধানের উৎপাদন ব্যয় যেমনি বাড়ছে, তেমনি অব্যাহত তাপ প্রবাহে সময়মত বোরো কর্তন নিয়েও শংকিত বরিশালের কৃষি যোদ্ধারা।
অপরদিকে বিরামহীন তাপ প্রবাহে বরিশালের প্রায় ১০ হাজার লেয়ার, ব্রয়লার ও সোনালী মুরগীর বানিজ্যিক খামার সহ গৃহস্থ্য পর্যায়ের প্রায় ৫ কোটি মুরগী ও তার বাচ্চার জীবন অনেকটাই সংকটাপন্ন। প্রাণি সম্পদ দপ্তর থেকে মাঠ পর্যায়ে পরিস্থিতি নিবিড় পর্যবেক্ষন সহ খামারীদের সব ধরনের পরামর্শ প্রদানের কথা বলা হলেও পরিস্থিতি ক্রমে সবার নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে। যেখানে মুরগীর খামারগুলোর অভ্যন্তরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০-৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে থাকার কথা, সেখানে বরিশাল অঞ্চলে গত প্রায় ২৫ দিন ধরে তাপমাত্রার পারদ ৩৯ ডিগ্রী অতিক্রম করায় খামার ও হ্যাচারীগুলোতে এক দুঃসহ পরিস্থিতি। একদিনের বাচ্চা থেকে ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালী মুরগীর জীবন ব্যবস্থা মারাত্মক বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখিন। এসব খামারে বিনিয়োগকৃত শত শত কোটি টাকা এখন ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে। ‘বর্তমান তাপ প্রবাহকে প্রাণি সম্পদ খাতের জন্য অত্যন্ত দুর্যোগপূর্ণ সময়’ বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। যা বরিশাল অঞ্চলের উদীয়মান পোল্ট্রি শিল্পের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী বরিশালে বানিজ্যিক ভিত্তিতে ২ হাজার ৭১ টি লেয়ার, সাড়ে ৪ হাজারের মত ব্রয়লার ও প্রায় আড়াই হাজার সোনালী মুরগীর খামার সহ গৃহস্থ্য পর্যায়ে অবানিজ্যিক, আধা বানিজ্যিক ও বানিজ্যিক খামার মিলিয়ে মোট মুরগির সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৯৫ লাখ। হাঁস পালিত হচ্ছে ১ কোটি ১২ লাখের কিছু বেশী। এ ছাড়াও বানিজ্যিক ও আধা বানিজ্যিক হ্যাচারীতে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মুরগির বাচ্চা প্রস্ফুটিত হচ্ছে। এর বাইরে আরো ১৫ লক্ষাধিক কবুতর ও ৪০ সহ¯্রাধিক টার্কি’ লালন পালন হচ্ছে বলে প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে।
চলমান তাপ প্রবাহ অব্যাহত থাকায় বরিশালের অভ্যন্তরীন ও উপকূল অভ্যন্তরের নদ-নদী থেকে ইলিশের ঝাক গভীর সমুদ্রে চলে যাবার আশংকা করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। গত ৩০ এপ্রিল বরিশাল,শরিয়তপুর, চাঁদপুর ও ভোলার মধ্যবর্তী মেঘনা, তেতুলিয়া, আড়িয়াল খাঁ ও কালাবদর নদীর অভয়াশ্রমে মৎস্য আহরণের দু মাসের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও জেলেরা  নদ-নদীতে নামতে পারছেন না উচ্চ তাপামাত্রার কারণে। পাশাপাশি ইলিশের অন্যতম প্রধান বিচরণস্থল এসব নদ-নদী অনেকটাই মাছ শূন্য।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, এসময়ে নদ-নদীতে পানির সহনীয় তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে থাকার কথা। কিন্তু তা ইতোমধ্যে ৩৬ ডিগ্রী অতিক্রম করায় পরিবেশ ইলিশ সহ অনুরূপ স্পর্শকাতর মাছের জন্য অনুকুল নয়। বাংলাদেশে মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর একাধিক বিজ্ঞানীর মতে ‘ইলিশ মাছের মাথায় ‘কেমো সার্ভার অর্গান’ রয়েছে যাদ্বারা তারা নদ-নদীর তাপমাত্রা ও গভীরতা সহ সম্পূর্ণ পরিবেশ বুঝতে পারে। ইলিশ কখনোই তার জন্য প্রতিকুল পরিবেশে বসবাস করেনা’। তাদের মতে, ‘যদিও ইলিশ ডিম ছেড়ে গভীর সমুদ্রে চলে যায় কিন্তু অনাবৃষ্টি সহ নদ-নদীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির মত প্রতিকুল পরিবেশে তারা বাস করতে চায়না’। ফলে ‘বর্তমান তাপ প্রবাহ অভিপ্রায়নী মাছ ইলিশের সাগরমুখি হবার প্রবনতা তরান্বিত করছে।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT