4:05 pm , March 24, 2024

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশালের মুক্তিকামী জনতা পাক হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। ২৬ মার্চ সূর্যোদয়ের সাথে সাথে বরিশালে আত্মপ্রকাশ করে মুক্তিবাহিনী।
তৎকালীন সংগ্রাম পরিষদের একাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে সাক্ষাতকালে তারা জানান, মুক্তিযুদ্ধ ও প্রশাসন পরিচালনার জন্য গঠন করা হয় একটি বিপ্লবী সংগ্রাম পরিষদ। বর্তমান নগরীর বরিশাল সরকারি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রথম সচিবালয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ওই সংগ্রাম পরিষদের তত্ত্বাবধানে বৃহত্তর বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনা জেলার স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা হয় এখান থেকে।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আলাপকালে তারা আরো জানান, প্রশাসন পরিচালনার জন্য গঠন করা হলো একটি শক্তিশালী সংগ্রাম পরিষদ। ওই পরিষদের বিভাগীয় প্রধানরা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মঞ্জুর (বেসামরিক বিভাগ), ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিল (প্রতিরক্ষা বিভাগ), বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক খান (অর্থ বিভাগ), মহিউদ্দিন আহম্মেদ (খাদ্য বিভাগ), আমিরুল হক চৌধুরী (বিচার বিভাগ), আমির হোসেন আমু (ত্রাণ বিভাগ), শামসুল হক (জ্বালানি বিভাগ), ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন (তথ্য বিভাগ), হাসান ইমাম চৌধুরী (সিভিল ডিফেন্স বিভাগ), সরদার জালাল উদ্দিন (যোগাযোগ বিভাগ), ডা. রহমত আলী (স্বাস্থ্য বিভাগ)। এ পরিষদের প্রধান সমম্বয়কারী ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন আহম্মেদ।
সংগ্রাম পরিষদের প্রথম সভায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সম্মুখ যুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর এমএ জলিল। তিনি বরিশাল বেলর্স পার্ক মাঠটি (বঙ্গবন্ধু উদ্যান) মুক্তিবাহিনীর জন্য প্রধান ট্রেনিং ক্যাম্প হিসেবে স্থান নির্ধারন করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর সারাদেশের ন্যায় বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলার মুক্তিকামী জনতা চূড়ান্ত ঘোষণার অপেক্ষারত ছিল। ২৫ শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চূড়ান্ত ঘোষণা আসার পর জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এলাকার ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের জনতাকে সংগঠিত করার কাজে ব্যস্থ হয়ে পড়েন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ সকল মুক্তিকামী জনতাকে একত্রিত করে বাঁশের লাঠি ও থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল দিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষন শুরু করা হয়।
বরিশাল বেলর্স পার্ক মাঠ, বদরপুর হাইস্কুল, মেমানিয়া হাই স্কুল, কাওরিয়া হাইস্কুল ও পিএন হাইস্কুল মাঠে শুরু হয় প্রাথমিক প্রশিক্ষন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম ভাগেই বরিশালের মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা বুদ্ধিমত্তার সাথে বিভিন্ন কৌশলে পাক-বাহিনীর সদস্যদের হটিয়ে দিতে সক্ষম হন।
১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাক-হানাদার বাহিনী ঝটিকা আক্রমন শুরু করে দেয় বরিশালের হিজলা উপজেলায়। স্থানীয় রাজাকার ও থানা পুলিশের সহযোগিতায় পাক-হানাদার বাহিনী বর্বরভাবে হানা দেয় গুয়াবাড়িয়া ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায়। শুরু করে দেয় নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর নারকীয় তান্ডব। লুটপাট করে নিয়ে নেয় সর্বস্ব। এরপর প্রায় অর্ধশত বাড়ি-ঘরে অগ্নিসংযোগ ঘটায়।
মুক্তি বাহিনী আসছে খবর পেয়ে দ্রুত কালিকাপুর ত্যাগ করে পাক বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের ৬ষ্ট ও ৭ম মাসে এসে যখন মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে জেলার বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনী পরাস্ত হচ্ছে। এমন সংবাদের ভিত্তিতে উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৩ অক্টোবর শেষ রাতে ফিল্ড কমান্ডার আবদুর রশিদ সিকদারের নেতৃত্বে হিজলা থানা আক্রমন করে। হানাদার বাহিনী ও থানা পুলিশের সঙ্গে প্রায় দুই ঘন্টা মুক্তি-বাহিনীর সমর যুদ্ধের পর আত্মসর্মপন করে পাক বাহিনী। ৪ ডিসেম্বর পাক-হানাদারমুক্ত হয়েছিল বরিশাল জেলার হিজলা উপজেলা।
এ প্রসঙ্গে বরিশাল জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার যুদ্ধাহত বীর-মুক্তিযোদ্ধা এ.এম.জি কবির ভূলু জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় হিজলা উপজেলার দায়িত্বে থাকা বীর-মুক্তিযোদ্ধারা এতোটাই সক্রিয় ও তৎপর ছিল যে, পাক-বাহিনী এদেশীয় দোসরদের আল-বদর, রাজাকার বাহিনী গড়ার চেষ্টা ভেস্তে যায়। তৎকালীন সময়ে অল্প কিছু ঘটনা ছাড়া পাক-বাহিনীর সদস্যরা হিজলা উপজেলায় বড় ধরনের কোন ধ্বংস যজ্ঞ চালাতে পারেনি। যার সম্পূর্ন কৃতিত্ব প্রতিটি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।