বরিশালে তরমুজের আবাদ ৩০ ভাগ হ্রাস বরিশালে তরমুজের আবাদ ৩০ ভাগ হ্রাস - ajkerparibartan.com
বরিশালে তরমুজের আবাদ ৩০ ভাগ হ্রাস

4:26 pm , March 19, 2024

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ গত বছর চৈত্রের মাঝারী বর্ষণে তরমুজ চাষীদের কপাল পোড়ায় এবার বরিশাল কৃষি অঞ্চলে আবাদ প্রায় ৩০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে (৬৬ হাজার হেক্টর থেকে ৪৬ হাজার হেক্টর)। উৎপাদনও গত বছরের ২৭ লাখ টন থেকে ২০ লাখ টনে নেমে আসার শঙ্কায়  কৃষিবিদরা। গত এক দশকেরও বেশী সময় ধরে সারা দেশে ৭০ ভাগ তরমুজের আবাদ ও উৎপাদন হচ্ছে বরিশাল অঞ্চলে। গত বছর সারা দেশে আবাদকৃত ৯২ হাজার হেক্টরের মধ্যে বরিশাল অঞ্চলেই ৬৫ হাজার হেক্টরে তরমুজের চাষ হয়।
উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা মহাদেশ ছাড়িয়ে সুমিষ্ট রসালো ফল তরমুজ বাংলাদেশের নদীবহুল বরিশাল অঞ্চলে ইতোমধ্যে অর্থকরী ফসলের তালিকায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরী করেছে। সারা বিশ^ সহ দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার  অধিকাংশ দেশেই তরমুজের আবাদ হলেও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এর আবাদ ও উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা অর্জন করেছে। যার সিংহভাগ অর্জনই বরিশালের কৃষি যোদ্ধাদের। বেলে দো-আঁশ থেকে এটেল দো-আঁশ পর্যন্ত সব ধরনের মাটিতে তরমুজের চাষ হচ্ছে। এমনকি নদ-নদীবহুল বরিশলের নোনা পানিমুক্ত চরাঞ্চলের পলি মাটিতে তরমুজের ভাল ফলন হচ্ছে।
কিন্তু সাম্প্রতিককালে অকাল বর্ষণ ও অব্যাহত অনাবৃষ্টি সহ আবহাওয়ার খেয়ালী আচরণ বিরুপ পরিস্থিতি তৈরী করছে। গতবছর টানা প্রায় ৫ মাস পরে মার্চের মধ্যভাগ থেকে কয়েক দফা হালকা থেকে মাঝারী ও ভারি বর্ষণে জমিতে পানি জমে মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয় তরমুজ বাগান। অনেক এলাকার চাষীরা মাঠ থেকে তরমুজ উত্তোলনই করতে পারেননি। কিছু এলাকার নিমজ্জিত তরমুজ উত্তোলন করে বরিশালের পোর্ট রোডের পাইকারি বাজারে নিয়ে এলেও তাতে পচন ধরায় সংলগ্ন জেলখাল সহ কীর্তনখোলা নদীতে ফেলে দেন চাষী ও ব্যবসায়ীরা। চাষীদের অনেক কষ্টের হাজার হাজার টন তরমুজ ভোক্তার পরিবর্তে নদী ও খালে ভেসেছে। ফলে আরো একবার ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে বরিশালের তরমুজ চাষীদের।
পাশাপাশি ফড়িয়া সিন্ডিকেটের কারণে মাঠে থেকে কৃষকরা অনেক কমমূল্যে তরমুজ বিক্রী করতে বাধ্য হওয়ায় এবার দেশের ৭০ ভাগ তরমুজের যোগান দেয়া বরিশাল কৃষি অঞ্চলে আবাদ প্রায় ৩০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। পাশপাশি রাঙ্গাবালী সহ সংলগ্ন এলাকায় ইতোমধ্যে তরমুজ বাগানে এক ধরনের মড়ক লেগেছে। এতেকরে গাছের ডগার রঙ বিবর্ণ হয়ে কখনো পচন শুরু হয়। সাথে ফলের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়ে অকালে ঝড়ে যাচ্ছে। ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট-বারি’ বরিশাল কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার মতে একই জমিতে অব্যাহত তরমুজ আবাদের ফলে এ ধরনের রোগ দেখা দিচ্ছে। প্রতি তিন বছর অন্তর ফসল পরিবর্তনের ওপর গুরুত্বারোপ করে মাঠ পর্যায়ের কৃষিকর্মী বা ব্লক সুপারভাইজারদের নিবিড় পর্যবেক্ষন ও সুপারিশের আলোকেই ফসল নির্ধারনের পরামর্শ দেন তিনি।
বর্ষজীবী, দিবস দৈর্ঘ্য, নিরপেক্ষ ও লতানো প্রকৃতির কুমড়া পরিবারের গাছ থেকে সুমিষ্ট রসালো ফল তরমুজ উৎপাদন হয়ে থাকে। মুলত ৫.৫ থেকে ৭.০ পিএইচ মাত্রার জমি সুমিষ্ট তরমুজ আবাদ ও উৎপাদনের জন্য উপযোগী হলেও কোন অবস্থাতেই তা অতিরিক্ত লবনাক্ততা সহ্য করতে পারেনা। পাশাপাশি খরা প্রতিরোধক ফসল তরমুজ অপেক্ষাকৃত শুষ্ক পরিবেশে বড় হয়ে উঠলেও বৃষ্টির অভাবে এর উৎপাদন ব্যাহত হবারও আশংকা থাকে। ফলে আবাদ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত ৩-৪টি সেচ প্রয়োগ করতে হলেও অতিবর্ষণ এর গাছ ও ফলকে বিনষ্ট করে।
‘বারি’র বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি উচ্চ ফলনশীল ও সুমিষ্ট তরমুজের জাত উদ্ভাবন করেছেন। গত বছর বরিশালে তরমুজের হেক্টর প্রতি গড় ফলন প্রায় ৪২ টনের মত বলে ডিএই জানালেও ‘বারি’ নির্দেশিত সুষম সার প্রয়োগ সহ আবাদ কৌশল অনুসরণ করলে তা সহজেই ৫০ টনে উন্নীত করা সম্ভব বলেও মনে করছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা।
মৌমাছির সাহায্যে পরাগায়িত হয়ে এ ফলের উৎপাদন নিশ্চিত হলেও সদূর অতীত থেকে ‘পতেঙ্গা’ ও ‘গোয়ালন্দ’ জাতের কালচে এবং নীলাভ গোলাকৃতির তরমুজের আবাদ হত। তবে তার মিষ্টতা বর্তমান প্রজন্মর চেয়ে অনেক কম ছিল। অধীক ফলন, মিষ্টতায় পরিপূর্ণ আধুনিক রসালো জাতের তরমুজের জনপ্রিয়তা সারা বিশে^ও ক্রমে বাড়ছে। এ অঞ্চলে ইউরোপীয়, প্রাচ্য ও গ্রীষ্ম মন্ডলীয় ‘টপইল্ড, গ্লোরী, কঙ্গো, চার্লসটনÑগ্রে, ইমিরিয়েল, জুবলী, সুপার ডেলিকেট, সুপার বেবী, সুইট ফেস্টিবল ও ফ্লোরিডা জয়েন্ট’ নামের একাধীক উন্নত জাতের তরমুজের আবাদ হচ্ছে।
কৃষি ও পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে তরমুজে যথেষ্ট পরিমান ভিটামিন-এ, রিবোফ্লাভিন, থায়ামিন ও পেপটিন বিদ্যমান রয়েছে। চীনা ভেষজবীদদের মতে তরমুজের রস রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। পাকা তরমুজের রসালো শাস স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় হবার পাশাপাশি তা অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক ও তৃষ্ণা নিবারক। উন্নত বিশ্বে তরমুজ দিয়ে নানা ধরনের সরবত, জ্যাম,সিরাপ, গুড় ছাড়াও এ্যালকহল পর্যন্ত  তৈরী হচ্ছে। এমনকি সইট্রেন শ্রেণির তরমুজ দিয়ে জেলি তৈরী হচ্ছে।
তবে বরিশাল সহ সারা দেশ প্রতি বছর শীত মৌসুমেই প্রায় ৩৫-৪০ লাখ টন তরমুজ উৎপাদন হলেও তা প্রক্রিয়াজাত করে কোন ধরনের খাদ্য সামগ্রী প্রস্তুতের উদ্যোগ নেই। বরিশালে দীর্ঘদিনই একটি ‘কৃষি ও মৎস্য ভিত্তিক রফতানী প্রক্রিয়াকরণ এলাকা’ প্রতিষ্ঠার দাবী সাধারন মানুষের। এঅঞ্চলের ইলিশ ছাড়াও উন্নতমানের পেয়ারা ও তরমুজ সহ অন্যন্য ফল ও ফসলকে কেন্দ্র করে একটি রফতানী প্রক্রিয়াকরণ এলাকা প্রতিষ্ঠিত হলে তা আর্থ-সামাজিক ব্যাবস্থায় যথেষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আশাবাদী অর্থনীতিবীদরা।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT