2:48 pm , March 17, 2024
বরিশালে ৩ লাখ ৯১ হাজার হেক্টরে বোরো আবাদ সম্পন্ন
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ কয়েক দফার ‘কোল্ড ইনজুরী’ সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে এযাবতকালের সর্বাধিক প্রায় ৩ লাখ ৯১ হাজার হেক্টরে বোরো আবাদ সম্পন্ন করলেন বরিশাল কৃষি অঞ্চলের কৃষকরা। যা ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৬২৫ হেক্টর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৮ হাজার হেক্টর বেশী। ফলে সমাপ্তপ্রায় রবি মৌসুমে বরিশাল অঞ্চলে বোরো ধান থেকে যে প্রায় ১৭ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল পাবার লক্ষ্য স্থির করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়, নির্বিঘেœ ঘরে তুলতে পারলে উৎপাদন ১৮ লাখ টনের মাইলফলক ছুঁতে পারে বলে আশা করছেন মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদরা। গত ১৫ মার্চ ছিল বোরো আবাদের শেষ দিন।
চলতি রবি মৌসুমে দফায় দফায় মৃদু থেকে মাঝারী শৈত্য প্রবাহে ‘কোল্ড ইনজুরী’র শিকার হলেও কৃষষকরা নানা লাগসই প্রযুক্তি অনুসরণ করে বেশীরভাগ বোরো বীজতলা রক্ষা করতে সক্ষম হন। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশী বীজতলা তৈরীর ফলে সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ কাটিয়ে ১৫ মার্চের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত বোরো আবাদ সম্পন্ন করেছেন কৃষকরা।
যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবার আগে বিপর্যয়ের শিকার হয় বরিশাল অঞ্চলের কৃষি সহ খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি। অথচ কৃষিনির্ভর এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে কৃষির কোন বিকল্প নেই। অপরদিকে সার ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি কৃষক ও কৃষি অর্থনীতির জন্য ইতোমধ্যে যথেষ্ট নাজুক পরিস্থিতি তৈরী করেছে। দু,বছর আগে রবি মৌসুমেই ডিজেলে প্রায় ৩০ ভাগ মূল্য বৃদ্ধি বোরো আবাদ ও উৎপাদনে নতুন সংকট তৈরী করে। এরপরে দু দফায় সারের মূল্যবৃদ্ধিও নতুন সংকট তৈরী করেছে। চলতি রবি মৌসুমে ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি মাত্র ৭৫ পয়সা হ্রাস করা হলেও তা বোরো সেচাবাদে তেমন কোন ইতিবাচক প্রভাব ফেলছেনা। সার,বীজ, সেচব্যায় ও কৃষি শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির ফলে এবারো বরিশাল অঞ্চলে এক মণ বোরো ধানের উৎপাদন ব্যায় হাজার টাকা অতিক্রম করবে বলে মনে করছেন কৃষিবীদরা। বিগত রবি মৌসুমে ধান কাটার পরে বিক্রী করে উৎপাদন ব্যায় তুলতে পারেননি সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক। কারণ দেনার দায়ে এঅঞ্চলের বেশীরভাগ কৃষকদের মাঠে থেকেই মাড়াই করে ধান বিক্রী করতে হয়। ফলে আগাম এ ধান বিক্রীতে ফড়িয়াদের সিদ্ধান্তকে মেনে নেওয়ার কোন বিকল্প থাকছেনা।
অপরদিকে এবারো বরিশাল অঞ্চলে ৩.৮৪ লাখ হেক্টরে সেচাবাদকৃত বোরো ধানের অন্তত ৭৫ ভাগ সেচ ব্যবস্থাই ডিজেল চালিত পাম্পের ওপর নির্ভরশীল। ফলে সারা দেশের তুলনায় বরিশাল অঞ্চলে বোরো উৎপাদন ব্যায় অন্তত ২৫ ভাগ বেশী। দেশে সেচাবাদে ব্যবহৃত বিদ্যুতের ওপর ২০০২ সাল থেকে সরকার ২০ ভাগ ভর্তুকি দিলেও ডিজেলের ক্ষেত্রে তা এখনো অনুপস্থিত। মিল মালিকদের নিয়োজিত ফড়িয়া সিন্ডিকেটের কারণে এ অঞ্চলে ধানের দামে কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না।
সেচ ব্যায় সারা বিশে^র মধ্যে বেশী হওয়ায় উৎপাদন ব্যায়ের তুলনায় ধানের দাম কম হওয়ায় কৃষকদের জীবনমানের কোন উন্নতি হচ্ছেনা। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের দেশে সেচ ব্যায় এখনো ধান উৎপদন ব্যায়ের প্রায় ২৮-৩০%। অথচ আমাদের নিকট প্রতিবেশী ভারতের মরুময় পাঞ্জাবে সেচ ব্যায় মোট উৎপাদন ব্যায়ের মাত্র ১৩%। যা থাইল্যান্ডে ৮% ও ভিয়েতনামে মাত্র ৬% ।
অপরদিকে প্রতিবছরই খরিপ-১, খরিপ-২ ও রবি মৌসুমে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াশ’,‘অশণি’ ও ‘সিত্রাং’এর মত ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করেই ধান সহ সব ফসল উৎপাদন করতে হচ্ছে কৃষিযোদ্ধাদের। এমনকি গত অক্টোবরে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’র পরে নভেম্বরে আরেক ঝড় ‘মিধিলি’ দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান দানাদার খাদ্য ফসল আমনের উৎপাদনে যথেষ্ট বিরূপ প্রভাব ফেলে। এর আগে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখার চোখ রাঙানীতেও আতংকে ছিল বরিশাল অঞ্চলের কৃষকরা।
একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষকদের ক্ষতির সাথে দু:শ্চিন্তাকে বৃদ্ধি করে চললেও বরিশাল কৃষি অঞ্চলে এবার ৩টি মৌসুমে দানাদার খাদ্য ফসল উৎপাদন ৫০ লাখ টন অতিক্রম করবে বলে আশাবাদী মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদরা। ইতোমধ্যে ১.৬০ লাখ টন উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রায় ৬০ হাজার হেক্টরে গমের কর্তণও শুরু হয়েছে। আউশের আবাদও শুরু হয়েছে। ফলে প্রায় ১৪ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত এ অঞ্চলে এবার নির্বিঘেœ বোরো ধান ঘরে উঠলে খাদ্য উদ্বৃত্তের পরিমান আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশাবাদী মাঠ পর্যায়ের কৃষিবীদরা।
বিগত খরিপ-২ মৌসুমে বরিশাল অঞ্চলে ৮ লাখ ৬৯ হাজার ৫৯৩ হেক্টরে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে কৃষি যোদ্ধারা ৮ লাখ ৮০ হাজার ৮৪৫ হেক্টরে আমন আবাদ সম্পন্ন করেন। যা ছিল লক্ষ্যমাত্রার প্রায় সাড়ে ১১ হাজার হেক্টর অতিরিক্ত। তবে বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা একের পর এক ঘূর্ণিঝড় বারবারই বিপর্যয় ডেকে আনলেও সব বাঁধা অতিক্রম করে বিগত মৌসুমে এ অঞ্চলে প্রায় ২৩ লাখ টন আমন চাল ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছেন বরিশালের কৃষকরা। যা ছিল লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৭০ হাজার টন অতিরিক্ত।
সমাপ্ত প্রায় রবি মৌসুমে দেশে ৫০ লাখ ৪০ হাজার ৪শ হেক্টরে বোরো আবাদ লক্ষমাত্রা অতিক্রম করায় ২ কোটি ২২ লাখ ৬৭ হাজার টন চাল উৎপাদনে দৃড় আশাবাদী কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর-ডিএই সহ কৃষি মন্ত্রণালয়। যা হবে এযাবতকালের সর্বোচ্চ।