বরিশালে সড়ক বিভাগে ১৩শ কোটি টাকার উন্নয়নের একি হাল !! বরিশালে সড়ক বিভাগে ১৩শ কোটি টাকার উন্নয়নের একি হাল !! - ajkerparibartan.com
বরিশালে সড়ক বিভাগে ১৩শ কোটি টাকার উন্নয়নের একি হাল !!

4:01 pm , March 4, 2024

আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ ট্রাক কতটা ভারী হলে বেইলী ব্রিজ ভেঙ্গে পড়ে থাকে খালে? ৫০ মিটারের সড়কে একাধিক বাঁক কেন থাকবে? এভাবেই প্রশ্ন তোলেন সাধারণ মানুষ বরিশাল বিভাগের সড়ক উন্নয়ন নিয়ে। সাধারণ মানুষের দাবী সরকার উন্নয়নের রোল মডেলে থাকলেও সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কথা ও কাগজের মারপ্যাঁচ করছে। কাগজ কলমে শতভাগ উন্নয়ন দেখিয়ে ফায়দা নিচ্ছে ঠিকাদার ও সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা। ফলে সড়ক ও সেতু একদিকে তৈরি হয়, অন্যদিকে ভেঙ্গে যায়। এ অঞ্চলের কোথাও পাঁচ বছর মেয়াদী টেকসই কোনো সড়ক নেই বলে দাবী বরিশালের চরকাউয়া, টুঙ্গিবাড়ীয়ার লাহারহাট, ঝালকাঠি জেলার নলছিটি, পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া ও বরগুনা জেলার গৌরীচন্না  এলাকাবাসীর। সরেজমিনে ৪ মার্চ সোমবার সকালে বরিশাল জেলার সদর উপজেলার টুঙ্গিবাড়ীয়ার লাহারহাট-ভোলা সড়কে যাবার পথে প্রথমেই চোখে পড়ে চরকাউয়া অংশের সদ্য নির্মিত সড়কের দুপাশে ভেঙ্গে পড়ার দৃশ্য। তিন কিলোমিটার এগিয়ে খানাখন্দের সড়কে ভোলা রোডের টুঙ্গিবাড়ীয়ার বেইলী ব্রিজ ভেঙ্গে খালে পড়ে থাকা ট্রাক ও বিকল্প পথ নির্মাণ চেষ্টা চোখে পড়ে। বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল রহমান মুকুল জানান, আজকের মধ্যে বিকল্প পথ তৈরি হয়ে যাবে। ট্রাকটিও উদ্ধার করা হবে বলে জানান তিনি।
গত ১ মার্চ দিবাগত রাতে বেইলী ব্রিজ ভেঙ্গে খালে পড়ে যায় একটি ট্রাক। পাশেই দাঁড়ানো দুর্ঘটনাকবলিত ট্রাকচালক মো. জাকির জানান, বেনাপোল থেকে বরিশাল-ভোলা হয়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার কথা তার। শনিবার মধ্যরাত সোয়া ২টার দিকে বরিশাল ভোলা মহাসড়কের টুঙ্গিবাড়িয়ার স্লুইস গেট এলাকার বেইলি ব্রিজটি ভেঙ্গে পড়ে। আর ওইসময় রড তৈরির কাঁচামালের লোহার কুঁচি ভর্তি ট্রাকটি নিয়ে ওই ব্রিজটি পারাপার হচ্ছিলেন তারা। ব্রিজটি ভেঙ্গে পড়ায় ট্রাকটি উল্টে খালে পড়ে যায়। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছেন।
ট্রাকচালক অভিযোগ করেন, বেইলি ব্রিজ ঝুঁকিপূর্ণ কিংবা কতটুকু পণ্য নিয়ে পার হওয়া যায় সে ধরনের কোনো সতর্কবার্তা নেই এই সড়কে। এমনকি ঠিকাদার ও সড়ক বিভাগের কেউই ছিলেন না। তারা যদি নিষেধ করতো তাহলে ব্রিজ পার হওয়ার সময় আরো সতর্কতা হতাম। কিন্তু নিজেদের দোষ ঢাকতে এখন উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিচ্ছেন সড়ক কর্তৃপক্ষ।
এসময় টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য অমর দেবনাথ জানান, বরিশাল-ভোলা-চট্টগাম মহাসড়কের সদর উপজেলার টুঙ্গিবাড়ীয়া ইউপির মেমানিয়া খালের ওপর বক্স কালভার্ট নির্মাণ চলমান রয়েছে। এ সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য পাশে একটি বেইলি ব্রিজ নির্মাণ করে দেওয়া হয়। এটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কোনো পণ্যবাহী যান পার হওয়ার সময় এটির মাঝখানে ডেবে যেত। বিষয়টি সড়ক ও জনপথ বিভাগকে এক সপ্তাহ আগে জানিয়ে মেরামতের কথা বলা হয়। তারা কথা শোনেনি বলেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানান অমর দেবনাথ।
এই মুহূর্তে ট্রাকটির উদ্ধার এবং সড়কে বড় যানবাহন চলাচল আটকে দিয়েছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাদিরা রহমান। তিনি বলেন, এই সড়ক ও ব্রিজের পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ এবং বিকল্প পথ তৈরির নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত এখানে শুধু ছোট যানবাহন চলাচল করবে, কোনো বড় গাড়ি চলাচল করতে পারবে না।
নাদিয়া রহমান আরো বলেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি মহাসড়ক। অথচ লাহারহাট  এলাকার কোনো উন্নয়নই হয়নি। বর্ষা হলে ফেরীঘাটে রীতিমতো হাটু কাদা পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। তিনি দ্রুত এই সড়ক ও ব্রিজের পূর্ণাঙ্গ নির্মাণ নিশ্চয়তা দাবী করেন।
এদিকে ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া ইউনিয়নে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদফতর (এলজিইডি) বাস্তবায়নে  উত্তর জুরকাঠি বিলের বাড়ি খালের ওপর ব্রিজ নির্মাণকাজ সম্প্রতি শেষ হয়। কিন্তু উদ্বোধনের আগেই ব্রিজটিতে ফাটল দেখা দেয়ায় স্থানীয় এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাই তড়িঘড়ি করে সেতুর দৃশ্যমান ফাটলে সিমেন্টের প্রলেপ দিয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ব্রিজের বিস্তারিত তথ্য জানতে চাইলে অপারগতা প্রকাশ করেন উপজেলা প্রকৌশলী মো. ইকবাল কবীর ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী মঈনুল আজম। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ হয়েছে।
বরিশাল থেকে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া ৯২ কিলোমিটার সড়কে রয়েছে ঝুকিপূর্ণ অসংখ্য বেইলী ব্রিজ। কয়েকটি ব্রিজ ভেঙ্গে নতুন ব্রিজ নির্মান কাজ গত প্রায় একবছর ধরে চলমান রয়েছে।  এই সড়কের সবচেয়ে আতঙ্ক সড়কের মোড় বা বাঁক। সড়কের উন্নয়ন কাজও মানসম্মত নয় বলে দাবী তুষখালী বাজারের ব্যবসায়ীদের। তারা বলেন, প্রতিবছর দু’বার পিচ ঢালাই করতে হয় এই সড়কে। একেতো সরু সড়কে পাশাপাশি দুটো গাড়ি হলেই যানজট তৈরি হয়। তার উপর বৃষ্টি হলেই সড়কে গর্ত তৈরি হয়, চটলা উঠে খানাখন্দ হয় বলে জানান তারা। সড়ক বিভাগের প্রকৌশলীদের কাউকে কদাচিত দেখা যায় বলে দাবী তাদের। বরগুনা জেলা সড়কের বাকেরগঞ্জ পর্যন্ত ৫৭ কিলোমিটার পথেরও একই অবস্থা।  সবচেয়ে বড় সমস্যা সরু সড়কে মির্জাগঞ্জের সুবিদখালী ও গৌরীচন্না বাজার হয়ে বরগুনা সদরে যেতে অনেকটা প্রান মুঠোয় নিয়ে চলতে হয় বলে অভিযোগ বাস চালকদেরও।
গত ২০২২-২৩ অর্থ বছরে এ অঞ্চলের সড়কের উন্নয়নে ১ হাজার ৩২৮ কোটি ১০ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে ১ হাজার ১৩২ কোটি ২৮ লাখ টাকা ছাড় হয়েছে বলে জানা গেছে। এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন  সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মকর্তারা। যার পুরোটাই ব্যয় হয়েছে এবং  বাস্তব অবকাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবী সড়ক বিভাগের। বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় ৮টি প্রকল্পের আর্থিক ও ভৌত আবকাঠামো খাতে অগ্রগতির হার ৯৯.৯৯% বলে দাবী করেন। এরমধ্যে সদ্য সমাপ্ত অর্থ বছরে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় বরিশাল জোনের বরিশাল- লক্ষ্মীপাশা- দুমকী জেলা মহাসড়কের ১৪ কিলোমিটার, রাঙ্গামাটি নদীর ওপর গোমা সেতু নির্মানে চলমান প্রকল্পের ব্যয় বরাদ্দের পুরো অর্থের বিপরীতে পূর্তকাজ সম্পন্ন হওয়ার দাবী তাদের। যদিও সরেজমিনে সড়কের ৬০ ভাগ ও গোমা সেতুর ৪০ ভাগ কাজই এখনো অসম্পূর্ণ দেখা গেছে । ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল- কুয়াকাটা জাতীয় মহাসড়কটি ৪ লেনে উন্নীত করনে ভূমি অধিগ্রহণ কাজের বিপরীতে ছাড়কৃত অর্থ জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের অনুকূলে প্রদান করা হয়েছে। যদিও জমি অধিগ্রহণ এখনো চলছে বলে জানিয়েছেন মাদারীপুর ও বরিশালের জেলা প্রশাসক।  বরিশাল-ভোলা-লক্ষ্মীপুর জাতীয় মহাসড়ক ও বরিশাল-টুমচর-বাউফল জেলা মহাসড়ক দুটি যথাযথ মান ও  প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের বিপরীতে ছাড়কৃত পুরো অর্থ ব্যয় সহ অবকাঠামো উন্নয়ন সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবী করছে বরিশাল সড়ক বিভাগ। এছাড়া লেবুখালী-রামপুর- মির্জাগঞ্জ সংযোগ সড়ক নির্মাণ, ভোলা-চরফ্যাশন/চরমানিক আঞ্চলিক মহাসড়কটির উন্নয়ন প্রকল্প ও চরখালী-তুষখালী-মঠবাড়ীয়া- পাথরঘাটা আঞ্চলিক মহাসড়কের জরাজীর্ণ ও অপ্রশস্ত বেইলী সেতু পরিবর্তন করে পিসি গার্ডার সেতু ও বক্স কালভার্ট  নির্মাণ প্রকল্পগুলোর ছাড়কৃত অর্থের বিপরীতে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে দাবী করলেও সরেজমিনে এসব কাজের কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। গত প্রায় বছর ধরে কয়েকটি পুরাতন সেতু ভেঙ্গে বিকল্প পথে যানবাহন চলাচলে বাধ্য করা হয়েছে। অপরদিকে বরিশাল-ফরিদপুর – ঢাকা জাতীয় মহাসড়কের সুগন্ধ্যা নদীর ভাঙ্গন থেকে ‘বীর শ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু রক্ষায় প্রায় পৌনে ৪ কিলোমিটার নদী তীরে স্থায়ী রক্ষাবাধ প্রকল্পের বিপরীতে ছাড়কৃত অর্থের বিপরীতে পূর্তকাজ সম্পন্ন হয়েছে। যা বাস্তবে দেখা না গেলেও ৮টি প্রকল্পের বিপরীতে সাড়ে ১১শ কোটি টাকা ব্যয় সহ এর বিপরীতে পূর্ত কাজ সমূহ সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবী বরিশাল সড়ক জোনের। এখানের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী একেএম আজাদ রহমান বলেন, চলতি অর্থ বছরে বরিশাল সড়ক অঞ্চলে নতুন ও চলমান প্রকল্পগুলোর ভৌত অবকাঠামোর কাজ অব্যাহত রয়েছে। প্রতিটি কাজের মান নিয়ন্ত্রনে বরিশাল সড়ক জোন ও সার্কেল থেকে নিয়মিত যথাযথ পর্যবেক্ষন ও নজরদারী অব্যাহত রয়েছে। কোন প্রকল্পের কাজের মান নিয়ে আপোষ করা হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT