4:22 pm , February 10, 2024
আযাদ আলাউদ্দীন, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশালের মধ্য কড়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির বিরুদ্ধে আনা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমানিত হওয়ার পর বিভাগীয় মামলা হয়েছে। কিন্তু অভিযুক্তরা যথারীতি বহাল তবিয়তে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন এবং বিভাগীয় মামলাকেও অগ্রাহ্য করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করার একাধিক অভিযোগ করেছেন অভিভাবকরা। জানা গেছে, বরিশাল সদর উপজেলার মধ্য কড়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতির বিরুদ্ধে অভিভাবকদের অভিযোগের কারণে বরিশাল বিভাগীয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির দেয়া প্রতিবেদনে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য প্রমানিত হওয়ার পর বিভাগীয় মামলা হয়েছে বলে জানা যায়।
ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুসরাত জাহান টানা ১৪ বছর একই স্কুলে কর্মরত আছেন। ২০১০ সালে তিনি ওই স্কুলে যোগদানের পর থেকে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় ইউপি সদস্য জহিরুল ইসলামের সাথে যোগসাজশ করে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি করে যাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে অভিভাবকরা প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিকার চেয়ে তাকে বদলির আবেদন জানান। একইসাথে তারা সাবেক সভাপতি ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতির বিরূদ্ধেও অভিযোগ তুলে ধরেন।
অভিভাবকরা জানান, বিগত ৮-১০ বছর যাবৎ এই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির (এসএমসি) সভাপতি ছিলেন রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জহিরুল ইসলাম । সরকারি প্রাইমারি স্কুল পরিচালনার নিয়ম অনুযায়ী একই ব্যক্তি পরপর দু’বারের বেশি কমিটির সভাপতি থাকতে পারে না। তা ছাড়া সরকারি নতুন আদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি হওয়ার জন্য গ্র্যাজুয়েশন থাকা আবশ্যক, যা জহিরুল ইসলামের নেই। তাই ২০২৩ সালের কমিটিতে শ্রাবণী আক্তার নামে একজনকে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু শ্রাবণী আক্তার সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের পরও তাকে ব্যাংক হিসেবের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে ব্যাংক হিসেবের যাবতীয় লেনদেন করেন প্রধান শিক্ষক নুসরাত জাহান এবং সাবেক সভাপতি জহিরুল ইসলাম। এতে বর্তমান সভাপতি অস্বস্তিবোধ করে সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম এতে ব্যাহত হচ্ছে বলে জানা যায়।
অভিভাবকরা জানান, এই স্কুলে ভর্তি ফরম ও প্রত্যয়নপত্র বাবদ শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে বাধ্যতামূলকভাবে অতিরিক্ত টাকা নেয়া হয়। বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দফতরের অনুমতি ছাড়াই বিদ্যালয়ের একাধিক গাছ কেটে বিক্রি করে সেই টাকাও আত্মসাৎ করেন প্রধান শিক্ষক ও সাবেক সভাপতি। এ ছাড়াও প্রধান শিক্ষক নুসরাত জাহান বিদ্যালয়ে সময়মতো আসেন না। এলেও যথাসময়ের আগেই বিদ্যালয় ত্যাগ করাসহ একাধিক অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
তাছাড়া এই স্কুলের জন্য বরাদ্দকৃত স্লিপের টাকা প্রতি বছর এলেও সেই টাকার যথার্থ ব্যবহার হয় না। প্রতিটি প্রান্তিক মূল্যায়নের উত্তরপত্র শিক্ষার্থীদের নিজ খরচে কিনে পরীক্ষার হলে আসতে হয়। অথচ এই উত্তরপত্র স্লিপের টাকা থেকে বহন করার কথা। পাঁচ বছর ধরে স্কুলের শ্রেণিকক্ষে বৈদ্যুতিক পাখা না থাকায় শিশুদের অসহনীয় কষ্ট ও দুর্ভোগের মধ্যে ক্লাস করতে হচ্ছে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হলেও কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
এ বিষয়ে প্রধান শিক্ষক নুসরাত জাহান অভিযোগগুলো অস্বীকার করে বলেন, আমি বরিশাল সদর উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক মনোনীত হওয়ার পর থেকে আমার বিরুদ্ধে স্থানীয় একটি চক্র প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতারা ষড়যন্ত্র করছেন।
সাবেক সভাপতি জহিরুল ইসলাম বলেন, বর্তমান সভাপতি শ্রাবণী আক্তার অসুস্থ থাকায় আমি ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি। এতদিন এ নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। হঠাৎ করে এ বিষয়ে আমার ও প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ কেন করা হচ্ছে, তা আমার জানা নেই। কর্তৃপক্ষ যা ব্যবস্থা নিবেন আমি তাই মেনে নেব। তিনি আরো বলেন, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির খুব বেশি ক্ষমতা থাকে না। বিভাগীয় মামলা হয়েছে, নিয়মানুযায়ী উত্তর দেব এবং আমরাও মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
বর্তমান সভাপতি শ্রাবণী আক্তার বলেন, আমি অসুস্থ নই। ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি জহিরুল ইসলাম ও প্রধান শিক্ষক নুসরাত জাহান আমাকে কাগজে-কলমে সভাপতি দেখিয়ে সব কাজ নিজেরাই করেন । আমি স্কুলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কোনো সিগনেটরিতে নেই। এসব অন্যায় অনিয়মের প্রতিবাদেই আমি ইস্তফা দিয়েছি।
এ বিষয়ে বরিশাল সদর উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আল মামুন বলেন, তদন্ত হয়ে গেছে। এখন বিভাগীয় মামলা চলছে। মামলা চলাকালীন কোনো মন্তব্য করতে চাইনা বলে জানান তিনি।
বরিশাল সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ফয়সাল জামিল বলেন, ইতোমধ্যে দু’টি তদন্ত প্রতিবেদন বিভাগীয় কার্যালয়ে জমা হয়েছে। প্রতিপক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আরেকটি তদন্ত চলমান রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের বরিশাল বিভাগীয় উপ-পরিচালক নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর আমরা বিভাগীয় মামলা করেছি। মামলার নিয়মানুযায়ী তাদের নোটিশ পাঠানো হয়েছে, এখন তারা উত্তর দেবেন। তাদের উত্তরের উপর নির্ভর করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি ।
দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত একজন প্রধান শিক্ষক উপজেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক মনোনয়ন পান কিভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তর নিলুফার ইয়াছমিন বলেন, দুষ্টুলোকের কৌশলের অভাব থাকে না। ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসার আগেই নুসরাত জাহানকে বরিশাল সদর উপজেলা থেকে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক মনোনীত করা হয়।