নিষিদ্ধকালীন সময়ে ভারত ও মায়ানমারের জেলেরা আমাদের নৌ সীমায় মাছ ধরায় সংকট বাড়ছে নিষিদ্ধকালীন সময়ে ভারত ও মায়ানমারের জেলেরা আমাদের নৌ সীমায় মাছ ধরায় সংকট বাড়ছে - ajkerparibartan.com
নিষিদ্ধকালীন সময়ে ভারত ও মায়ানমারের জেলেরা আমাদের নৌ সীমায় মাছ ধরায় সংকট বাড়ছে

3:42 pm , February 4, 2024

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রনে ক্রমাগত নাব্যতা সংকট বৃদ্ধি এবং অবাধে শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্য অপসারণের ফলে বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চল ও সংলগ্ন উপকূলভাগে ইলিশের বিচরণ ক্রমাগত পূর্ব-দক্ষিণ উপকূলে সরে যাচ্ছে। সাথে আহরণ নিষিদ্ধকালীন সময়ে বঙ্গোপসাগরে আমাদের সীমার অভ্যন্তরে ভারতীয় জেলেদের অবাধ মৎস্য আহরণ মৎস্য সম্পদের ওপর আরো বিরুপ প্রভাব ফেলছে। অতি নিকট অতীতেও বরিশালের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলভাগে যেখানে ৬৮-৭০ ভাগ ইলিশ আহরণ হতো। গত কয়েক মাসে তা প্রায় অর্ধেকের মত হ্রাস পেয়েছে। একইসাথে বিগত গ্রীষ্ম মৌসুমে অতিরিক্ত তাপ প্রবাহ ও মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির ব্যাপক ঘাটতির সাথে শীত মৌসুমে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের ৩-৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত হ্রাস পাবার কারণেও ইলিমের বিচরনস্থল পরিবর্তন সহ জেলেরা নদ-নদী ও সাগর উপকূলে নামতে না পারায় ইলিশ আহরণ অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। এ দাবী মৎস্যজীবীদের। খুব সহসাই ইলিশের অবাধ ও সুস্থ বিচরণ সহ প্রজনন ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটাতে না পারলে আগামীতে উৎপাদনেও বিরুপ প্রভাব সৃষ্টির আশংকার কথা বলেছেন একাধিক মৎস্য বিজ্ঞানী।
গত বছরের ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনের মূল প্রজনন মৌসুমের ২২ দিনের আহরণ নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে দেশের ইলিশ প্রজন্মে আরো  অন্তত ৪১ হাজার কোটি জাটকা যুক্ত হয়েছে বলে মনে করছেন মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট এর বিজ্ঞানীরা। যা পূর্ববর্তী বছরে ছিল ৪০ হাজার ২৭৬ কোটি। বিগত মূল প্রজননকালীন সময়ে  দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় প্রজনন এলাকায় ৫২.০৪ ভাগ মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দশমিক ৫ ভাগ বেশী এবং আরো অন্তত ৩৫ ভাগ মা ইলিশ ডিম ছাড়ারত ছিল বলে গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, ইলিশ উৎপাদনের ক্রমবর্ধনশীল ধারায় এখনো খুব বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়লেও ভবিষ্যতে বিরুপ পরিবেশ ও নানামুখি প্রাকৃতিক সমস্যা নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরী করতে পারে। তাদের মতে, মনুষ্য সৃষ্টি নানা কর্মকান্ডের সাথে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তনে এবার ইলিশের বিচরণ স্থলে নানামুখি বিরুপ প্রভাবে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চল সহ সংলগ্ন উপকূলভাগে এবার ইলিশের বিচরণ কম থাকায় আহরণ কিছুটা কম লক্ষ্যনীয়। ফলে বাজারে সরবরাহ ঘাটতির সাথে মূল্যও আকাশচুম্বি।
এরমধ্যেও বিগত দূর্গা পুজার সময় বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরূপ ভারতে প্রায় ৪ হাজার টন ইলিশ রপ্তানী করা হয়েছে স্থানীয় বাজার দরের চেয়ে অনেকটাই কম মূল্যে। দেশের মানুষের জন্য সহনীয় মূল্যে ইলিশ সরবরাহের লক্ষ্যে প্রায় ১০ বছর ধরে ইলিশ রপ্তানী বন্ধ রয়েছে। কিন্তু আহরণ হ্রাস সহ বাজারে যোগান কম থাকায় বরিশালের খুচরা বাজারে এখন সাড়ে ৮শ গ্রাম থেকে ১ কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রী হচ্ছে সাড়ে ১২শ থেকে ১৪শ টাকা কেজি। এরপর থেকে সাইজ যত বড়, দামও তত বেশী। তবে গত ১ নভেম্বর থেকে জাটকা নিধনে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বরিশাল সহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে জাটকার অবাধ বিপণন অব্যাহত রয়েছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, এবার মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি সহ জীব বৈচিত্রের নানা পরিবর্তনের সাথে হাইড্রো-মেট্রোলজিক্যাল সমস্যায় ইলিশের বিচরণ ক্ষেত্র পরিবর্তন হচ্ছে। ইতোপূর্বে খেপুপাড়া, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, মনপুরা,ঢালচর, চরকুকরী-মুকরি, চর কচ্ছপিয়া ও সংলগ্ন সাগর এলাকায় ইলিশের যে  বিচরণ ছিল এবার তা অনেকটাই পূর্ব-দক্ষিণে সন্দ্বীপের দক্ষিণ হয়ে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন এলাকায় সরে গেছে। তাও অতীতের মত অফুরন্ত নয়। ধারণা করা হচ্ছে ইলিশ অনেকটাই গহীন সমুদ্রে চলে গেছে। এর পেছনে উজানে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের সাথে সময়মত বৃষ্টিপাতের অভাবে পদ্মা-মেঘনা ও এর শাখা নদ-নদীগুলোতে প্রবাহ হ্রাস সহ পানির দূষনের মাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টি কাজ করছে বলে মৎস্য বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
গত বছরের জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলে কোন বৃষ্টি হয়নি। এপ্রিলে স্বাভাবিকের তুলনায় কিছু বেশী বৃষ্টি হলেও জুন-জুলাইতে তা ছিল স্বাভাবিকের কম। ভরা বর্ষা মৌসুমের জুলাই মাসে বরিশালে বৃষ্টিপাতের পরিমান ছিল স্বাভাবিকের ৫৮% কম। কিন্তু আগস্টে ৮০% এবং সেপ্টেম্বরে প্রায় ১২% বেশী বৃষ্টি হয়েছে। এমনকি গত অক্টোবর ও নভেম্বরে স্বাভাবিকের প্রায় দেড়গুন বৃষ্টি হয়েছে বরিশাল সহ উপকূলভাগে।
মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আশরাফুল আলম জানান, চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনা ও ডাকাতিয়ার মোহনায় যে ¯্রােত অতীতে ছিল বিগত বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাব সহ উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের ফলে তা লক্ষ্য করা যায়নি। উপরন্তু চাঁদপুর থেকে সাগর মোহনা পর্যন্ত দেড়শর’ও বেশী ডুবোচর সৃষ্টি হয়ে ইলিশের গতিপথ রুদ্ধ হচ্ছে। আবার যেখানে নদীর গভীরতা বেশী সেখানে নৌপথের মূল চ্যানেল হওয়ায় জেলেরা জাল ফেলতে পারছে না।
এমনকি শীত মৌসুমে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের প্রায় ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস নিচে নেমে যাবার সাথে লাগাতার মাঝারী থেকে ঘন কুয়াশায় জেলেরা সাগর ও নদ-নদীতে নামতে না পারায় সরবারহে ব্যাপক ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। ড. আশরাফুল আলমের মতে, অতিমাত্রায় শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্য অপসারণের ফলে নদ-নদীতে ইলিশের প্রধান খাবার ফাইটো প্লাঙ্কটন ও জু-প্লাঙ্কটনের ঘাটতি অতীতের যেকোন সময়ের তুলনায় এবার প্রকট আকার ধারণ করেছে। যেখানে প্রতি লিটার পানিতে ফাইটো প্লাঙ্কটন ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার থাকার কথা, সেখানে তা দেড় হাজারের নিচে এবং জিও প্লাঙ্কটন ১৫শর স্থলে কোন কোন নদীতে ২-৩শতে নেমে এসেছে। ফলে খাবারের অভাবেও ইলিশ সাগরের উপকূল অতিক্রম করে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে আসছেনা। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, সীমান্তের ওপর সহ উজানের সব নদ-নদীর প্রায় ৭০ ভাগ পানি মেঘনা ও এর শাখা নদী নদী দিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। কিন্ত সীমান্তের ওপারে নিয়ন্ত্রনে প্রবাহ যেমনি বাধা গ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্যরে কারণে দূষণের মাত্রাও ক্রমশ বাড়ছে। পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে অতিরিক্ত তাপ প্রবাহের ফলেও ইলিশ সাগর থেকে নদীমুখী  হচ্ছে না। ইলিশ বিচরণের জন্য যেখানে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানির তাপমাত্রা ২৮-৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থাকা প্রয়োজন, সেখানে বিগত গ্রীস্ম মৌসুমে তা ৩৪-৩৫ ডিগ্রী অতিক্রম করে বলেও জানান তিনি।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, জীবনচক্রে অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। পূর্ণাঙ্গ ইলিশ প্রতিদিন ¯্রােতের বিপরীতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলে উপকূলের প্রায় সাড়ে ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্তভাবে ভাসমান ডিম ছাড়ার পরে তা থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে বিচরণ করে। এরা খাবার খেয়ে নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে ৭Ñ১০ সপ্তাহ ভেসে বেরিয়ে জাটকা হিসেব কিছুটা বড় হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পরিপক্কতা অর্জন করে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২Ñ১৮ মাস অবস্থানে প্রজননক্ষম হয়ে ইলিশ আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।
২০২২ সালের প্রজন মৌসুমে দক্ষিণ উপকূলসহ সংলগ্ন অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে প্রায় ৮৪% মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। এরমধ্যে ৫২ ভাগ মা ইলিশ ২২ দিনের মূল প্রজননকালীন সময়ে এবং পরবর্তিতে আরো ৩২% ডিম ছাড়ারত ছিল। যা ছিল অগের বছরের প্রজননকালের চেয়ে প্রায় ২.৪৫% বেশী।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যলয়ের মৎস্য অনুষদের অধ্যাপক ড. সাজেদুল ইসলামও মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর বিজ্ঞানীদের সাথে  একমত পোষণ করে ইলিশের বংশ বিস্তার সহ নদ-নদীর হাইড্রো-মেট্রোলজিক্যাল বিষয়গুলোর প্রতি নজরদারীর আহবান জানিয়েছেন।
এদিকে বঙ্গোপসাগরে আমাদের সীমায় প্রতি বছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই ছাড়াও আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে পড়ের ২২দিন সব ধরণের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ থাকলেও ভারত ও মায়নমারের জেলেরা এসময়ে অবাধে আমাদের নৌ সীমা থেকে মাছ ধরে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের জলসীমায় শুধুমাত্র ১৫ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মৎস্য আহরণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মিয়ানমারেও জুন থেকে আগষ্ট পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও এ দুটি দেশের জেলেরাই আমাদের নিষিদ্ধকালীন সময়ে বঙ্গোপসাগরে নৌ সীমা অতিক্রম করে অবাধে মাছ লুটে নেয় বলে সুস্পষ্ট অভিযোগ রয়েছে। জাতীসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-ফাও’এর বিজ্ঞানী ড. হাসনাত সহ অন্যান্য মৎস্য বিজ্ঞানীরা ‘প্রতিবেশী দেশের সাথে সমতা রেখে সাগরে মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণার সময় বিবেচনার’ ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT