3:27 pm , January 22, 2024

নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ নগরীতে লাইসেন্স বিহীন যে কয়টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ছিলো তারমধ্যে অন্যতম হলো সাউথ মেডিনোভা সিটি সেন্টার। সরকারী নিবন্ধন না থাকায় গত বছর প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করার জন্য বরিশাল স্বাস্থ্য বিভাগ,সিভিল সার্জন ও জেলা প্রশাসন কে চিঠি দিয়েছিলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু রহস্যজনক কারণে জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেনি।
বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে বিভাগীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের খাতায় কাগজে কলমে বন্ধ দেখানো হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি। অথচ গতকালও প্রতিষ্ঠানটিতে রোগী পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে দেখা গেছে। জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মারিয়া হাসান বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি বন্ধের জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলো তা আমিও জানি। কিন্তু আমার তো ম্যাজিষ্ট্রেসি পাওয়ার নেই। তাই এ দায়িত্ব ছিলো জেলা প্রশাসনের উপর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনার পরও কেন বন্ধ করেনি এটা তারাই ভাল বলতে পারবে।
বরিশাল স্বাস্থ্য বিভাগীয় পরিচাক ডাঃ শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতাল ক্লিনিকের বিরুদ্ধে আমাদের সাড়াশি আভিযান চলমান আছে। আমাদের পরিসংখ্যানে সাউথ মেডিনোভা বন্ধ রয়েছে। তারপরও যদি তারা গোপনে সচল রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করে তাহলে দ্রুত সেটি সিলগালা করে দেওয়া হবে।
বরিশাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র বলছে, লাইসেন্স পাওয়ার জন্য অবকাঠামোগত সহ যে সব প্রয়োজনীয় উপকরণ দরকার তার অধিকাংশ না থাকা ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার কারনে সাউথ মেডিনোভা কে লাইসেন্স প্রদান করেনি স্বাস্থ্য অদিধপ্তর। যখন লাইসেন্স পাওয়ার সব আশা ক্ষীণ হয়ে আসছিলো ঠিক তখনই প্রতারণার আশ্রয় নেয় সাউথ মেডিনোভা কর্তৃপক্ষ। তারা পরিদর্শন টিমের সভাপতি তৎকালীন স্বাস্থ্য বিভাগীয় পরিচালক ডাঃ হুমায়ুন শাহীন খান ও সদস্য সচিব জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মারিয়া হাসানের স্বাক্ষর জাল করে একটি পজেটিভ রিপোর্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে প্রেরণ করে। ঠিক তখনই বিষয়টি নজরে আসে বরিশাল স্বাস্থ্য বিভাগের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কে প্রকৃত ঘটনার বর্ননা দিয়ে চিঠি দেন সিভিল সার্জন। এর পর চাউর হয় প্রতারণার বিষয়টি। এরপরই প্রতিষ্ঠানটি বন্ধের জন্য জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ কে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ওই চিঠির পর জেলা প্রশাসন থেকে একজন ম্যাজিষ্ট্রেট নিয়োগ করা হয় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। কিন্তু ম্যাজিষ্ট্রেট সরেজমিনে গিয়ে প্রতিষ্ঠান মালিকদের ডেকে সর্তক ও ওয়ার্নিং দিয়ে চলে আসেন। এরপর আর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। পরিদর্শন টিমের মন্তব্য রিপোর্টে বলা ছিলো ‘সাউথ মেডিনোভা সিটি সেন্টারের ভৌত অবকাঠামো সন্তোষজনক নয় এবং সিটি স্ক্যান কক্ষ মান সম্মত নয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম, ছবি, শিক্ষা সনদ, নিয়োগ ও যোগদান পত্র সঠিক নেই। অনলাইন রিপোর্টিং সিস্টেম নেই। এরকম অন্তত ৩৯ টি শর্তের প্রায় সবগুলোই নেই। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিতে এত নাই, নাই থাকার পরও রোগীদের সাথে প্রতারণা করে দাপটের সাথে চলছে অদ্যবধি।
তথ্য বলছে, ২০২১ সালে নগরীর বান্দ রোডে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিপরীতে যাত্রা শুরু করে সাউথ মেডিনোভা সিটি সেন্টার। প্রতিষ্ঠানের নামকরণ সাইনবোর্ডে মেডিনোভা সিটি সেন্টার অক্ষরগুলো লেখা হয়েছে অনেক বড় ও আকর্ষনীয় করে আর সাউথ শব্দটি লেখা হয়েছে ছোট ও সুক্ষ্ম করে। এই লেখার একটি উদ্দেশ্য রোগীরা যেন বুঝে নেয় এটি বিখ্যাত ও স্বনামধন্য মেডিনোভা গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। যা রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে প্রতারণার শামিল। বিষয়টি টের পেয়ে বরিশাল মেডিনোভা কর্তৃপক্ষ বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কাছে সাউথ মেডিনোভার লাইসেন্স বন্ধ রাখার জন্য একাধিকবার আবেদন করেন। অভিযোগে বলা হয় ‘মেডিনোভা মেডিকেল সার্ভিসেস লিমিটেড এবং বরিশাল সিটি সেন্টার দুটি প্রতিষ্ঠান মেডিনোভা গ্রুপের। কিন্তু এই দুটি প্রতিষ্ঠানের লোগো ও নাম ব্যবহার করে রোগীদের সাথে প্রতারণা করছে সাউথ মেডিনোভা সিটি সেন্টার।
সারাদেশে অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বিরোধী সাড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হলেও বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা একবার জরিমানাও গুনতে হয়নি এই প্রতিষ্ঠানটিকে। কারণ যতবারই অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে তার আগেই সাউথ মেডিনোভা সিটি সেন্টার তালাবদ্ধ করে পালিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ এটা প্রমানিত যে, আগেভাগেই অভিযানের খবর জেনে যেত সাউথ মেডিনোভা সিটি সেন্টার কর্তৃপক্ষ। ফলে বরিশাল স্বাস্থ্য সেক্টরের একটি পক্ষ এই কাজের সাথে যে জড়িত তা অনেকটা নিশ্চিত।
এদিকে শুধু নামকরণে প্রতারণা করেই থেমে থাকেনি এই প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে রোগী ভাগাতে ও বেশী রোগী পেতে শেবাচিম হাসপাতালে কর্মরত ২০/৩০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রাখা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা তথা পরিচালনা পর্ষদে। কিন্তু সরকারী বাধ্য বাধকতার কারণে সরকারী হাসপাতালে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামগুলো গোপন রেখে প্রকাশ্যে আনা হয়েছে অন্য মালিক ও শেয়ার হোল্ডারদের। যারা সরকারী বাধ্য বাধকতার বাইরে। প্রশাসন কিংবা স্বাস্থ্য বিভাগকে তারা ওই মালিক তথা শেয়ার হোল্ডারদের ওই চুক্তিনামা প্রদর্শন করে। আর শেবাচিম হাসপাতালে কর্মরত যে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সাথে জড়িত তাদের সাথে করা হয়েছে ভিন্ন অপর একটি চুক্তি পত্র। যা অভ্যন্তরীণ ও গোপনীয়। প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় প্রতিটি পদক্ষেপে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া সাউথ মেডিনোভা সিটি সেন্টার প্যাথলজিক্যাল লাইসেন্স না পেলেও ইতিমধ্যে অনেকটা অলৌকিকভাবে বাংলাদেশ পরমানু শক্তি কমিশন নিয়ন্ত্রন কর্তৃপক্ষ থেকে সনদ পেয়েছে। পেয়েছে পরিবেশ সনদ ও সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্সও।