কেতনার বিল গণহত্যা: মৃত্যুঞ্জয়ী যতীনের কথা কেতনার বিল গণহত্যা: মৃত্যুঞ্জয়ী যতীনের কথা - ajkerparibartan.com
কেতনার বিল গণহত্যা: মৃত্যুঞ্জয়ী যতীনের কথা

3:32 pm , January 20, 2024

কমল সেনগুপ্ত ॥ পাকিস্তানী হানাদাবাহিনী গুলিবর্ষণ শুরু করলে মা হরিমালা ছোট দু’সন্তানকে কোলে নিয়ে দৌঁড়ে পালাবার  চেষ্টা করে। এক কোলে এক বছরের শিশু কন্যা, আর ডান হাতে সাড়ে তিন বছরের যতীন। আর পেছনে আর বড় মেয়ে। নাড়ি ছেঁড়া ধনদের নিয়ে ৫০/৬০ গজ যেতেই হঠাৎ গুলি। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল বড় মেয়ে। হারিয়ে গেল যতীনের কাজলা দিদি। মেয়ের রক্তাক্ত দেহ পাকিস্তানী হায়েনাদের ব্রাশ ফায়ার। গুলিতে উড়ে যায় হরিমালার মাথায় খুলি। আবার গুলি। একটি বুলেট বাম পাঁজর ভেদ করে ছিটকে দেয় শিশু কন্যাকে আরেকটি বুলেট হরিমালার ডান হাত উড়িয়ে যতীনের ডান হাতের কনুই ভেদ করে কব্জির নীচ দিয়ে বেড়িয়ে যায়। মা হরিমালা দু’সন্তান সহ লুটিয়ে পড়ে পুকুর পাড়ে। সামনেই মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে শত শত মানুষ। ১৯৭১ সালের ১৬ মে কেতনার বিল গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী রাজেন পাত্র এ ভাবেই বর্ণনা করেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা মৃত্যুঞ্জয়ী  যতীনের কাহিনী।
‘শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত শিশু মরে গেল, যশোর রোডের যুদ্ধ ক্ষেত্রে ছেঁড়া সংসার সব এলোমেলো, কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে। শুধু যশোর রোড নয়। ১৯৭১ বাংলার পথে হয়েছিল গণহত্যা। পথে পথেই বধ্যভূমি। রাজেন পাত্র জানান, ফিরে দেখি লাশ আর লাশ। সে এক নারকীয় দৃশ্য! ভোলা যায় না। আমাদের এলাকায় প্রায় মাইলব্যাপী এই  হত্যাযজ্ঞ চলে। কিছু লাশ বিলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। দুর্গন্ধ এড়াতে কিছু লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়।এলাকার লোক ২ মাস পর্যন্ত ওই জল খায়নি। ভয়ে লোকজন ৫- ৬মাস পর্যন্ত  বাজারেও আসেনি।  আমাদের  বাড়ীর ১৯ জন জনকে ঐদিন হত্যা করা হয়। পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখি একটি শিশু গায়ে রক্তমাখা। গুলিতে মারা  যাওয়া মায়ের  দুধপানের চেষ্টা করছে।  শিশুটিআর ডান হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমরা শিশুটিকে উদ্ধার করে গ্রামের এক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাই। কিছুদিন পর খবর পেয়ে এক মামা শিশু যতীনকে নিয়ে যায়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ওঠে সে তবে ডান কব্জি সহ হাত বেঁকে যায়। পঙ্গুত্ব নিয়ে আজও বেঁচে আছে  যতীন। গতকাল কথা হয় যতীনের সাথে। মাঠে কাজ করছিল সে। বাম হাত দিয়েই সব কাজ   করে। তিনি বললেন, ‘গণহত্যার দেশের মানুষ আমি। মাতা কি জিনিস জানি না। শুধু গল্প শুনেছি যে, মরা মায়ের বুকের ওপরে পইড়ড়া ছিলাম’। মায়ের কোন স্মৃতি নেই তার। তবু বেঁচে আছেন একাত্তরের দুঃখ গাঁথা হয়ে। আজও পায়নি সরকারি স্বীকৃতি, কোন সহায়তা। ‘আকাশে বসত মরা ঈশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে’।
‘আমি চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া করিতে পারিনি চিৎকার, বুকের ব্যথা বুকে চাপায়ে নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার। যার চলে যায় সেই বুঝে হায় বিচ্ছেদে কী যন্ত্রণা, অবুঝ শিশুর অবুঝ প্রশ্ন কি দিয়ে দেব শান্তনা’।একাত্তর বড়ই রক্তাক্ত।লাশ আর লাশ। বিলে রক্তের নহর। বাংলার আনাচকানাচে শুধুই গণহত্যার সাক্ষী বহনকারী এক ইতিহাস। একটি স্বাধীন দেশের জন্মের আগে যে কত রক্ত বয়েছিল, তার হিসেব নেই। এমনই আরেক গণহত্যার নাম ‘কেতনারবিল গণহত্যা’। সেই বিভীষিকা আর ক্ষত আজও দগদগে! বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠলে যতীন  আজও খোঁজে তার শোলক বলা কাজলা দিদিকে, সেই পুকুর ধারে দাঁড়িয়ে খোঁজে মাকে। কিন্তু মা আর ফেরে না।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT