4:20 pm , January 2, 2024
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ নগরীর পলাশপুরের বাসিন্দা রাহেলা খাতুন কাজ করতেন আশেপাশের তিন চারটি বাড়িতে। মাসে আয় হতো ৩-৪ হাজার টাকা। কিন্তু গত একসপ্তাহ কাজে যায়নি রাহেলা। বললেন, কাজ থেকে পনের দিনের ছুটি নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণার কাজ নিয়েছি। লিফলেট বিতরণসহ জনসমাবেশে উপস্থিত থাকলে প্রতিদিন ৬০০ টাকা আয় হয়। কোনো কোনো দিন ১০০০ টাকাও পাই। ‘নির্বাচন আইলে আমাগো গরীবের লাইগা আশীর্বাদ অয়। ১০/১২ দিনেই রোজগারি কামের ডবল টাহা আয় হরতে পারি’ বলে হাসেন রাহেলা। একইচিত্র নগরীর রসুলপুর, কেডিসি ও বঙ্গবন্ধু কলোনীতে। এখানেও নারীদের বেশিরভাগকে ঘরে পাওয়া যায়নি মঙ্গলবার সকালে। কেডিসি সংলগ্ন বালুর মাঠ কলোনীর রিকশাচালক মজিবর বললেন, এখানের বেশিরভাগ মেয়েরা এখন নির্বাচনী প্রচার প্রচারণার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। গত ১৯ ডিসেম্বর থেকেই তারা বিভিন্ন দলের ব্যানার পোস্টার ও লিফলেট নিয়ে গণসংযোগে অংশ নিচ্ছে।তিনি বলেন, বেশিরভাগ মেয়েরা এসআর সমাজকল্যাণ সংস্থার সদস্য। তাই ট্রাকের প্রচার প্রচারণায় অংশ নিয়ে দুপয়সা উপার্জন করছে বলে জানান মজিবর। এসময় কলোনীর কয়েকজন বাসীন্দা আরো জানান, তাদের অনেকে বিএনপির নির্বাচন বর্জনের লিফলেট বিতরণেও অংশ নিচ্ছে। তবে গতবারের তুলনায় এবার নৌকার প্রচারণায় তাদের খুব একটা ডাকা হয়নি। ঈদগাহ ময়দানে ওয়ার্ড বৈঠকে শুধু ডাকা হয়েছিল বলে জানান তারা।নৌকা, ট্রাক বা অন্যান্য যেকোনো দলের লিফলেট বিতরণে আধাবেলা ২০০/৩০০ টাকা সারাদিন ৪০০/৫০০ টাকা করে পায় এলাকার নারী ও তরুণরা।এমন পরিস্থিতিতে নগরীর বেশিরভাগ বাসাবাড়িতে গৃহকর্মী সংকট তৈরি হয়েছে বলে জানালেন ভুক্তভোগী গৃহকর্তা তসলিউদ্দিন। মধ্য আলেকান্দার বাসিন্দা তসলিমউদ্দিন বলেন, আমি ও আমার স্ত্রী দুজনেই অসুস্থ। সন্তানরা ঢাকায় বসবাস করে। মাস চুক্তিতে একজন গৃহকর্মী রাখা ছিলো। গত দুই বছর ধরে সে কাজ করছে। বঙ্গবন্ধু কলোনীতে থাকে সে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় পাঁচ দিন ছুটিতে ছিলো। এখন আবার ১০ দিনের ছুটি নিয়ে গেছে শ্বাশুড়ি অসুস্থ বলে। লোকের মুখে শুনেছি, সে নির্বাচনের কাজ নিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে লিফলেট বিতরণ করছে। আমাদের এখন কষ্ট হচ্ছে বলে জানান তিনি। একই কথা বললেন আমতলা মোড়ের পানির ট্যাংক কালু খান বাড়ি সড়কের বাসিন্দা হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, গ্রাম থেকে দূর সম্পর্কের এক গরীব আত্মীয় আমার বাসায় থেকেই গৃহকর্মের সব কাজ করতো। গত ২০ ডিসেম্বর সে ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে। শুনেছি বরগুনা-১ আমতলী তালতলি আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থীর ডাকে ছুটে গেছে সে। ভোটের পরে আসবে বলে গেছে। যেকোনো নির্বাচনের সময়ে নগরীসহ গ্রামগঞ্জের নারীদের চাহিদা খুব বেড়ে যায়। বোরখা পরে দলবদ্ধ হয়ে প্রতিটি গ্রাম থেকে নি¤œবিত্তের অন্তত আট-দশজন নারী নির্বাচনী প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে উপার্জনের পথ বের করে নেন বলে জানান চাঁদপুরা ইউনিয়নের তালুকদার হাট মসজিদের ঈমাম মোকলেছুর রহমান। তিনি বলেন, আমাদের গ্রাম থেকে শিল্পী, মরিয়ম সহ কয়েকজন নৌকার প্রচারণায় নেমেছে। আবার পাশের মৌলবীর হাট ও গজনীর দীঘি এলাকার পরিচিত কয়েকজন গেছেন ট্রাকের প্রচারণায়।নির্বাচন এলেই সারাদেশের মতো বরিশালেও নারীকর্মীদের কদর বেড়ে যায়। বিশেষ করে বাসাবাড়িতে নির্বাচনী প্রচার প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন নারী কর্মীরা। দলীয় নেতাকর্মীদের বাইরেও তখন নারী কর্মী ভাড়া করতে হয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে। আর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভরসা হয়ে ওঠেন তার ভাড়াটে নারী কর্মীরা। এ কথায় একবাক্যে সহমত পোষণ করেন বরিশালের নারী নেত্রী সাংবাদিক ও সনাক সাবেক সভাপতি শাহ সাজেদা, উন্নয়ন সংস্থার প্রধান রহিমা সুলতানা কাজল এবং নগর চিন্তাবিদ কাজী মিজানুর রহমান। তাদের সাথে কথা বলে ও সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বরিশালের ছয়টি আসনেই নারী কর্মীরা দল বেঁধে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিজ প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইছেন। এসব নারী কর্মীরা বলেন, এ কাজে শারীরিক পরিশ্রম কম, আবার মজুরি অন্যান্য কাজের চেয়ে কিছু বেশি। তাই নির্বাচন এলেই ভোটের প্রচারণার কাজ বেছে নেন তারা।বরিশাল-৫ আসনে নির্বাচনী প্রচারণার কাজে ব্যস্ত ৩০ নং ওয়ার্ডের রহিমা বেগম বলেন, সকাল ১০টা থেকে বিকেল পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি নিজ প্রার্থীর প্রতীক পৌঁছে দিয়ে ভোট চাইছেন। এ জন্য তাঁকে প্রতিদিন ৪০০ টাকা করে দেওয়া হয়।নাম প্রকাশ না করার শর্তে বরিশাল-৬ আসনের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী বলেন, নির্বাচনী প্রচারণায় নিজেদের নারী আত্মীয়স্বজন প্রচারণা চালাচ্ছেন। পাশাপাশি দরিদ্র পরিবারের মেয়েরাও খাবার বাবদ কিছু টাকার বিনিময়ে তাঁর নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাইছেন। নারী কর্মীরা বাসাবাড়িতে ঢুকে সহজে প্রচারকাজ চালাতে পারেন, এ জন্য নির্বাচনী প্রচারে নারী কর্মীদের কদর বেড়েছে বলে জানান তিনি।আর বরিশাল ৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাউদ্দিন রিপন বলেন, প্রায় ৫০ হাজার নারী কর্মী রয়েছে তার। এসআর সমাজকল্যাণ সংস্থার নারী কর্মীর পাশাপাশি খাবারের বিনিময়ে গরীব নারীরাও প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এ ছাড়া আত্মীয়স্বজন তো আছেই।এটা একটা ভালো দিক দাবী করে বরিশালের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি নগর চিন্তাবিদ কাজী মিজানুর রহমান বলেন, লক্ষ লক্ষ টাকা কালো টাকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই নির্বাচনকে ঘীরে। তার কিছুটা এই গরীব মানুষগুলো ছয়-সাত দিন কাজ করে, কষ্ট করে উপার্জন করে নিচ্ছে। এটা দোষের কিছু নয়। নগরীর ৩০ ওয়ার্ডে এটা হয়তো হাজার তিনেক নারী শ্রমিক পাচ্ছেন। তারা এই ছয়-সাত দিন তাদের নিয়মিত কাজের জায়গা থেকে ছুটি নিয়ে এ কাজ করছে। তারাতো চুরি – ডাকাতি করছে না। কষ্ট করেই উপার্জন করছে বলে জানান কাজী মিজান।