4:30 pm , October 31, 2023

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ নির্বিঘœ প্রজনন নিশ্চিতকরণে ইলিশ নিয়ে ২২ দিনের পরিবহন ও বিপণন নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকার মধ্যেই মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাত থেকে সারাদেশে ইলিশ পোনা-জাটকা আহরণে ৮ মাসের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হল। জাটকা আহরণ সহনীয় পর্যায়ে নিয়ন্ত্রন করতে পারলে চলতি অর্থ বছরে দেশে ইলিশের উৎপদন গত অর্থ বছরের ৫.৭০ লাখ টন থেকে ৬ লাখ টনের কাছে পৌঁছতে পারে বলে মনে করছে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল মহল। আগামি ২ নভেম্বর দিবাগত মধ্যরাতে উপকূলের ৭ হাজার ৩৪২ বর্গ কিলোমিটারে সব ধরনের মাছ সহ সারাদেশে ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও ৩০ জুন পর্যন্ত জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ থাকছে। জাটকা আহরণে নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে দক্ষিণাঞ্চল সহ উপকূলীয় এলাকায় নৌবহিনী, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও র্যাব সহ বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করবে। মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল অঞ্চলের উপ-পরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ^াস জানিয়েছেন, বিগত বছরগুলোতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় ভ্রাম্যমান আদালত এবং মৎস্য বিভাগের অভিযানের ব্যাপক সাফল্য এসেছে। এসব অভিযানের ফলে দেশে বিপুল পরিমাণ জাটকা অবৈধ আহরণ থেকে রক্ষা পাওয়ায় ইলিশ সম্পদ আরো সমৃদ্ধ হবার আশা প্রকাশ করেনে তিনি।
তবে ইলিশ আহরণে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার আগেই জাটকা আহরণে এ বিধি নিষেধে জেলে পারিবারগুলোতে কিছুটা বিষাদের ছায়া লক্ষ্য করা গেছে। অবশ্য এবারো সরকার ইলিশ আহরণে নির্ভরশীল জেলেদের খাদ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায় ৩৭টি জেলার ১৫৫টি উপজেলার প্রায় সাড়ে ৫ লাখ জেলের মাঝে চাল বিতরণ করবে বলে জানা গেছে। এরমধ্যে বরিশাল অঞ্চলের ৪১টি উপজেলার সাড়ে ৩ লাখেরও বেশী জেলের মাঝে চাল বিতরণ করা হবে । দেশে উৎপাদিত ইলিশের প্রায় ৭০% ই পাওয়া যায় দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীণ নদ-নদী ও উপকূলীয় এলাকায়।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ ¯্রােতের বিপরীতে প্রতিদিন ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলতে সক্ষম। জীবনচক্রে এরা স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। উপকূলের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্ত ভাসমান অবস্থায় ডিম ছাড়ার পরে তা থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে বিচরণ করে খাবার খেয়ে নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে ৭-১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়ায়। এরা জাটকা হিসেবে কিছুটা বড় হয়ে ১২-১৮ মাস সমুদ্রে অবস্থান করে পরিপক্কতা অর্জন করে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসের পরে প্রজননক্ষম হয়ে এসব ইলিশ আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে।
সমুদ্রে যাবার সময় পর্যন্ত যেসব এলাকায় জাটকা খাদ্য গ্রহণ করে বেড়ে ওঠে, মৎস্য বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী সেগুলোকে ‘গুরুত্বপূর্ণ নার্সারী ক্ষেত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করে ‘অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে ইলিশের বংশ অনেকটাই রক্ষা পাচ্ছে। আমাদের মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে বরিশালের হিজলা ও মেহেদিগঞ্জের লতা, নয়া ভাঙ্গনী ও ধর্মগঞ্জ নদীর মিলনস্থল পর্যন্ত, ভোলার ভেদুরিয়া থেকে পটুয়াখালী চর রুস্তম পর্যন্ত তেঁতুুলিয়া নদীর ১শ’ কিলোমিটার, পটুয়াখালীর কলাপাড়ার আন্ধারমানিক নদীর ৪০ কিলোমিটার, মদনপুর থেকে ভোলার চর ইলিশা হয়ে চরপিয়াল পর্যন্ত মেঘনার শাহবাজপুর চ্যানেলের ৯০ কিলোমিটার, চাঁদপুরের ষাটনল থেকে লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১শ’ কিলোমিটার, শরিয়তপুরের নড়িয়া থেকে ভেদরগঞ্জ নি¤œ পদ্মার ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত মোট ৬টি অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। এসব অভয়াশ্রমে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যায়ক্রমে ২-৩ মাস পর্যন্ত সব ধরনের মৎস্য আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে। ফলে জাটকা নিধন থেকে রক্ষা পেয়ে ইলিশ সহ সব মাছের উৎপাদন বাড়বে বলেও দাবী মৎস্য বিজ্ঞানী সহ মৎস্য অধিদপ্তরের। আহরণ নিয়ন্ত্রণ সহ নজরদারী বৃদ্ধির ফলে দেশে জাটকার উৎপাদন ২০১৫ সালে ৩৯ হাজার ২৬৮ কোটি থেকে ২০১৭ সালে ৪২ হাজার ২৭৪ কোটিতে উন্নীত হয়। গত বছরও ২২ দিনের মূল প্রজননকালে দেশে প্রায় ৮ লাখ ৫ হাজার কেজি ডিম ছেড়েছে মা ইলিশ। যার প্রস্ফুটনে দেশে ৪০ হাজার ২৭৬ কোটি জাটকা ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এর সদ্য বিদায়ী মহা পরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ। আমাদের অর্থনীতিতে ইলিশের একক অবদান এখন ১%-এরও বেশী, আর মৎস্য খাতে প্রায় ১২%।