3:30 pm , October 25, 2023

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বর্তমান শিক্ষানীতি শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নষ্ট করছে। শ্রেণিকক্ষের বাইরে পাঠদান এবং মোবাইল ডিভাইস নির্ভর করছে। এতে অভিভাবকদের অতিরিক্ত খরচের মুখে পড়তে হচ্ছে। ফলে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা ঝরে যাচ্ছে। এছাড়াও এই শিক্ষানীতির কারণে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মোবাইল ফোনে আসক্তি হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন এর ব্যানারে বরিশালসহ কয়েকটি জেলার অভিভাবকরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদী মানববন্ধন শুরু করেছেন। এর আগে গত ১৩ অক্টোবর নতুন কারিকুলাম সংস্কার করে পরীক্ষা পদ্ধতি ফিরিয়ে আনাসহ সাত দফা দাবিতে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘শিক্ষা আন্দোলন সম্মিলিত অভিভাবক ফোরাম’ এর ব্যানারে মানববন্ধনে এ দাবি জানানো হয়।
বুধবার বেলা এগারো টায় বরিশাল নগরের অশ্বিনী কুমার টাউনহলের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে অভিভাবকরা ব্যানার ফেস্টুন নিয়ে চলমান শিক্ষানীতি বাতিল বা সংস্কারের দাবী তোলেন।
এতে বক্তব্য রাখেন শিক্ষার্থীদের পক্ষে মিফতাহুল জান্নাত এবং অভিভাবকদের পক্ষে আইরিন আক্তার পপি, মোস্তাফিজুর রহমান লিটু, নিলিমা খানসহ আরো অনেকে। এসময় তারা পথচারী ও রিক্সা, ইজিবাইক যাত্রীদের মধ্যে লিফলেট বিতরণ করেন। সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন এর ব্যানার আয়োজিত এই মানববন্ধনে বক্তারা ৮ দফা দাবী তুলে ধরে বলেন, চলতি বছর থেকে বাংলাদেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে। নতুন এই শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে ১ম, ২য়, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণিতে। আগামী বছর ৩য়, ৪র্থ, ৮ম এবং ৯ম শ্রেণিতে যুক্ত হবে এবং ২০২৫ সালে যুক্ত হবে ৫ম ও দশম শ্রেণিতে। ২০২৬ সালে একাদশ এবং ২০২৭ সালে যুক্ত হবে দ্বাদশ শ্রেণিতে।
বক্তারা বলেন, বর্তমান শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থাকলেও নতুন এই শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিককে কোনো বিভাগ বিভাজন থাকবে না। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির সবাইকে পড়তে হবে ১০টি অভিন্ন বিষয়। বর্তমানে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি মিলিয়ে এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু নতুন কারিকুলামে কেবল দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর অনুষ্ঠিত হবে এসএসসি পরীক্ষা। নতুন শিক্ষাক্রমে একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভাগ পছন্দ করতে পারবে এবং একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষে আলাদা দুটি বোর্ড পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এ দুই পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের সমন্বয়ে তৈরি হবে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল। যা জটিল বলে দাবী করেন অভিভাবকরা।
তারা বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই। চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে হবে আটটি বিষয়। নতুন শিক্ষাক্রমে তাত্ত্বিক বিষয়ের চেয়ে শিখনকালীন মূল্যায়নকে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে এবং সাময়িক পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দেয়া হয়েছে। এরফলে ছাত্র/ছাত্রীরা অধ্যয়নমুখী হচ্ছে না এবং বইয়ের সাথে দূরত্ব বাড়ায় ডিভাইসমুখী হচ্ছে তারা। এতে হুমকির মুখে পড়ছে তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ। সবচেয়ে বড় সমস্যা দলগত কার্যক্রমে। দেখা যাচ্ছে স্কুল থেকে প্রদত্ত দলগত কাজটি করতে হচ্ছে স্কুল পিরিয়ডের পর। যে কারণে শিক্ষার্থীদের বন্ধু-বান্ধবীর বাসায় বা অন্য কোথাও একত্রিত হয়ে তা সম্পন্ন করতে হচ্ছে। এতে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে শিক্ষার্থী-অভিভাবক উভয়কেই। অধিকাংশ অভিভাবক স্কুল ছুটির পর তার সন্তানকে অন্য কারো বাসায় নিয়ে যেতে আগ্রহী নয় এবং স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না বলে জানান অভিভাবকদের কয়েকজন। তারা বলেন, বর্তমান শিক্ষাক্রমে শিখনকালীন কাজের অংশ হিসেবে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ছাত্র ছাত্রীদেরকে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হচ্ছে। যার ফলে তারা সম্মুখীন হচ্ছে নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যার। অপরদিকে প্রজেক্টগুলির ইকুইপমেন্ট যত্রতত্র না পাওয়া সেই সাথে চড়া দামের কারণে এগুলি কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা। শহরের সচেতন ও স্বচ্ছল অভিভাবকরা এই শিক্ষা উপকরণের যোগান দিতে পারলেও মফস্বল এলাকার অভিভাবকরা এগুলির যোগান দিতে পারছেন না। ফলে দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা ঝরে পড়ছে বলে জানান তারা। গ্রামাঞ্চলে আগের তুলনায় শিক্ষার্থী ঝরে পরার সংখ্যা অনেক বেশি দাবী করে অভিভাবকরা বলেন, গত ৯ মাসের বিভিন্ন জরিপ বলছে গ্রামের স্কুলগুলিতে এই শিক্ষাক্রম ১০% ও সফল হয়নি। এমতাবস্থায় এই শিক্ষাক্রম সংস্কার বা বাতিলের জোর দাবি জানাচ্ছেন ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকরা। “চিহ্ন ভিত্তিক মূল্যায়ন” নতুন শিক্ষাক্রমের আরো একটি সমস্যা বলে দাবী করেন তারা। বিশেষ করে এই পদ্ধতি রাখার কারণে অভিভাবকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তারা জানিয়েছেন এই পদ্ধতিতে তারা তাদের বাচ্চাদের উন্নতি-অবনতির বিষয়ে ধারণা পাচ্ছে না। তারা দাবি জানিয়েছেন পূর্বের ন্যায় নম্বর ও গ্রেড ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি করা হোক। আলোচনা শেষে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে ৮ দফা দাবী পেশ করা হয়। দাবীগুলো হলো : নতুন কারিকুলাম
নবম শ্রেণিতে বিভাগ রাখতে হবে। ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ ইত্যাদি ইন্ডিকেটর বাতিল করে নম্বর ও গ্রেড ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখতে হবে। শিখন ও অভিজ্ঞতা ভিত্তিক ক্লাসের সমস্ত ব্যয় স্কুলকে বহন করতে হবে এবং স্কুল পিরিয়ডেই সকল প্রজেক্ট সম্পন্ন করতে হবে। শিক্ষার্থীদেরকে দলগত কাজে ডিভাইসমুখী হতে অনুৎসাহিত করতে হবে এবং তাত্ত্বিক বিষয়ে অধ্যয়নমুখী করতে হবে। প্রতি বছর প্রতি ক্লাসে রেজিস্ট্রেশন ও সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।সকল শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই তা মন্ত্রী পরিষদ এবং সংসদে উত্থাপন করতে হবে।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় শিক্ষা ব্যবস্থা হলো কেরানি তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থা। স্বাধীন দেশের নাগরিকদের জন্য সেটি নয়। কেরানি তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে প্রতিটি মানুষের সৃজনশীলতার পরিপূর্ণ বিকাশ অনেক সীমিত করে। কাজেই আমরা এখন বঙ্গবন্ধুর দেখানো সেই পথে শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা আমূল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি। বঙ্গবন্ধু ‘ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করেছিলেন। সেই সময়ে কমিশন একটি শিক্ষা নীতি তৈরি করেছিল। তবে সেই নীতিটি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি জাতির পিতা। ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে আরেকটি শিক্ষা নীতি করেছি, সেটি ড. কুদরত-ই-খুদা কমিশনের সেই শিক্ষানীতি অনুসরণ করেই।‘
শিক্ষামন্ত্রী আরো বলেন, শিক্ষাকে এখন রূপান্তর ঘটিয়ে যে জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, সেই রূপান্তর ঘটানোর জন্য নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়েছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্ব এখন শিক্ষায় রূপান্তর ঘটিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম তৈরির চেষ্টা করছে, বাংলাদেশ সেখানে অগ্রগামী অবস্থানে। আমরা ২০২৩ সালে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু করে দিতে পেরেছি। এ বছর মাধ্যমিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এবং প্রাথমিকে প্রথম শ্রেণিতে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ আমরা প্রাক-প্রাথমিক থেকে পুরো শিক্ষাক্রমটি বাস্তবায়ন করবো। নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীলতার চর্চা করতে শিখবে। এর মধ্য দিয়ে আমরা দক্ষ ও স্মার্ট নাগরিক আমরা তৈরি করতে পারবো।’
দীপু মনি বলেন, ‘আগের সেই ব্যবস্থায় একটি কারখানা থেকে যেন একই রকম মানুষ তৈরি হচ্ছিল। নতুন এই শিক্ষাক্রমে যেই শিক্ষার্থীর যেদিকে মেধা আছে, সৃজনশীলতা আছে; সেই শিক্ষার্থীকে সেদিকে আরেকটু যতœ নিয়ে পুরোপুরি বিকশিত করার সুযোগ আছে। এতে করে আমরা আমাদের জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবো, এ দেশটিকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো।’
সম্প্রতি অভিভাবকদের আন্দোলন ও তাদের ৮ দফা দাবী সম্পর্কে দীপু মনি বলেন, অভিভাবকদের যে আন্দোলন সেটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের প্রণীত শিক্ষানীতির কোথাও শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত চাপ বা পৃথক কোনো প্রজেক্ট নেই। শিখন পদ্ধতি সম্পূর্ণ শ্রেণি কক্ষেই সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পৃথকভাবে কোচিং বা দলগত প্রজেক্ট নেই। শিশু কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য উপযোগী প্রতিটি বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী।