খুলনা শিপইয়ার্ড গত অর্থ বছরে প্রায় ৭শ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে ৩৯ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছে খুলনা শিপইয়ার্ড গত অর্থ বছরে প্রায় ৭শ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে ৩৯ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছে - ajkerparibartan.com
খুলনা শিপইয়ার্ড গত অর্থ বছরে প্রায় ৭শ কোটি টাকার পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে ৩৯ কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করেছে

3:10 pm , October 14, 2023

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বাংলাদেশ নৌ বাহিনী নিয়ন্ত্রিত খুলনা শিপইয়ার্ড ঐতিহ্যের ধারা অব্যাহত রেখে গত অর্থ বছরে প্রায় ৭শ কোটি টাকা মূল্যমানের একাধিক নৌযান তৈরী এবং মেরামত ও মেরিন রাবার সামাগ্রী ছাড়াও বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে প্রায় ৩৯ কোটি টাকা মুনাফা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। করোনা মহামারীর মধ্যে খুলনা শিপইয়ার্ড এর আগের দুটি অর্থ বছরেও প্রায় ১৮৩ কোটি টাকা আয়কর ও ভ্যাট প্রদানের পরেও প্রায় ১২৫ কোটি টাকা মুনাফা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। গত অর্থ বছরের আগের ৩টি অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটির টার্ণওভার ছিল প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।
‘আইএসও’ সনদপ্রাপ্ত এ প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে কারিগরি দক্ষতায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সেরা নৌ নির্মান প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে। সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ের ‘ন্যাশনাল প্রোডাকটিভিটি অর্গানাইজেশন-এনপিও’র রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্পখাতে ‘ন্যাশনাল প্রোডাকটিভিটি এন্ড কোয়ালিটি এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছে খুলনা শিপইয়ার্ড। একাধিকবার দেশের দক্ষিণÑপশ্চিমাঞ্চলের সেরা করদাতার গৌরব অর্জনেও সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এক সময়ের রুগ্ন ও বিশাল দায়দেনা নিয়ে ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে নৌ বাহিনীর কাছে হস্তান্তরের পরবর্তী অর্থ বছর থেকে লোকসান কাটিয়ে উঠতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি যে প্রতিষ্ঠানটি মাসের পর মাস শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারত না, সেখানে শ্রমিক কল্যান তহবিলেও নিয়মিত অর্থ প্রদান করেছে। গত অর্থ বছরেও খুলনা শিপইয়ার্ড শ্রমিক কল্যান তহবিলে ১.৫৮ কোটি টাকা নগদ পরিশোধ করেছে বলে জানা গেছে।
গত তিনটি অর্থ বছরে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার স্টিল সামগ্রী ব্যবহার করে। বর্তমানে খুলনা শিপইয়ার্ডের নীট সম্পদের পরিমান দেড়শ কোটি টাকার ওপরে। মাত্র ৩২ জন সামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে দেড় সহ¯্রাধিক বেসামরিক কর্মকর্তাÑকর্মচারীর নিরলস পরিশ্রমে নৌযান নির্মান ও মেরামত থেকে শুরু করে অটোমোবাইল ট্রান্সপোর্ট মেরামত, নদ-নদীতে ড্রেজিং ও নদী ভাঙন প্রতিরোধ কার্যক্রমও বাস্তবায়ন করছে প্রতিষ্ঠানটি। এখানে ১০ টন পর্যন্ত গান মেটাল এবং হোয়াইট মেটাল ঢালাই, যেকোন নৌযানের নকশা, স্টিল স্ট্রাকচারের ফেব্রিকেশন ও নকশা প্রনয়ন সহ ছোট থেকে মাঝারী ও বড় নৌযানের মেরামতও দক্ষতার সাথে সম্পন্ন হচ্ছে।
এ ইয়ার্ডটি ইতোমধ্যে যুদ্ধ জাহাজ সহ ৮ শতাধিক বিভিন্ন ধরনের নৌযান নির্মান ছাড়াও ড্রেজার সহ আড়াই হাজার নৌযানের মেরামত কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছে। দেশের মাটিতে সফলভাবে প্রথম যুদ্ধ জাহাজ হিসেবে ৫টি পেট্রোল ক্রাফট  এবং ২টি লার্জ প্যাট্রোল ক্রাফট নির্মান ছাড়াও চীনা কারিগরি ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘সিএসওসি’র সহযোগীতায় ২য় ব্যাচের আরো ৫টি প্যাট্রোল ক্রাফট নির্মান করেছে খুলনা শিপইয়ার্ড ।
তৎকালীন পশ্চিম জার্মেনীর সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন-এর মালিকানায় রূপসা নদীর তীরে খুলনা শিপইয়ার্ডের যাত্রা শুরু করে ১৯৫৭ সালে। প্রাথমিকভাবে জার্মান ও যুক্তরাজ্যের যৌথ ব্যবস্থাপনায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম পরিচালিত হলেও স্বাধীনতার পরে বিএসইসি-এর ব্যবস্থাপনায় কিছুদিন লাভজনকভাবে পরিচালিত হয়। পরবর্তীতে অব্যাহত লোকসানে শিপইয়ার্ডটি বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। কয়েকবার বিক্রীর চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিষ্ঠানটি নৌ বাহিনীর কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। শতাধিক কোটি টাকা লোকসান ও দায়দেনা সহ ঐবছরের ৩ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে নৌ বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয় খুলনা শিপইয়ার্ড।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ দূরদর্শী সিদ্ধান্ত কার্যকরের পরে প্রতিষ্ঠানটি আর পেছনে ফিরে তাকায়নি। নৌ বাহিনীর দক্ষ, সৎ ও কর্তব্য পরায়ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরলস প্রচেষ্টায় সব লোকসান ও দায়দেনা কাটিয়ে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয় খুলনা শিপইয়ার্ড।
খুলনা শিপইয়ার্ড সাফল্যজনকভাবে ‘সাবমেরিন হ্যান্ডলিং টাগ’ পর্যন্ত তৈরী করেছে। প্রতিষ্ঠানটি দেশের আধা সামরিক বাহিনী কোষ্ট গার্ডের জন্যও বিভিন্ন ধরনের পেট্রোল ক্রাফট এবং ফায়ার সার্ভিসের জন্য ফায়ার ফাইটিং বোট ও পন্টুন তৈরী সম্পন্ন করেছে। বিআইডব্লিউটিএ’র ‘৩৫ ড্রেজার নির্মান প্রকল্প’র আওতায় দেশীয় প্রায় ৫শ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪টি ড্রেজার ও সমসংখ্যক ক্রেনবোট তৈরীর কাজও শুরু করেত যাচ্ছে খুলনা শিপইয়ার্ড। এসব বিশেষায়িত নৌযান তৈরীর ফলে দেশের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। এ শিপইয়ার্ড ইতোপূর্বে বিআইডব্লিউটিসি ও নৌ কল্যান ফাউন্ডেশনের জন্য ৬টি অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার জাহাজও নির্মান করেছে। এছাড়া মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর জন্য একাধীক অত্যাধুনিক গবেষনা নৌযানও নির্মান করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
খুলনা শিপইয়ার্ডে প্রায় ৩শ ফুট দৈর্ঘ্যরে ৭শ টন উত্তোলনক্ষম ১০টি ট্র্যাকের স্লীপওয়ের সাথে জেটিতে একই সাথে ৮টি নৌযান বার্থিং বা ভেড়ার ক্ষমতা রয়েছে। বছরে ৪ হাজার টন লৌহজাত সামগ্রী তৈরীর ক্ষমতা সম্পন্ন এ ইয়ার্ডে বিভিন্ন ক্ষমতার একাধীক ওভারহেড ক্রেন সহ মোবাইল ক্রেন এবং ফর্ক লিফটারও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে অত্যাধুনিক সহায়ক যন্ত্রপাতি সহ প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নিজস্ব ‘ফেব্রিকেশন সেড’ গড়ে তোলায় সময় বাঁচিয়ে দ্রুততার সাথে যেকোন নৌযানের নির্মান কাজ শেষ করার দক্ষতা অর্জন করেছে। ৩৩ মিটার উচ্চতা, ১শ মিটার লম্বা দ্বৈত ট্রাক সমৃদ্ধ এ ফেব্রিকেশন শেড-এ ২০ টন ক্ষমতার দুটি ওভারহেড ক্রেন রয়েছে।
এমনকি শিপইয়ার্ডটির প্লাটারশপ, ফেব্রিকেশন শেড, মেরিন ওয়ার্কশপ, ইলেক্ট্রিক্যাল ও রেডিও ইলেক্ট্রিক্যাল ওয়ার্কশপ, ফাউন্ডেরী শপ, কার্পেন্ট্রিং শপ ছাড়াও ডকিং সেকশন ইতোমধ্যে অত্যাধুনিক মেশিনারীতে সমৃদ্ধ করা হয়েছে।
চীনা কারিগরি সহায়তায় ইতোমধ্যে একটি অত্যাধুনিক রাবার ফ্যাক্টরী গড়ে তোলা হয়েছে খুলনা শিপইয়ার্ডে। যার মাধ্যমে রাবার আইটেম তৈরীর জন্য নিজস্ব ডিজাইন হাউজ, মোল্ড ফেব্রিকেশন এর জন্য অত্যাধুনিক সিএনসি মেশিন, প্রোডাকশনের জন্য রোলিং, নিডার এক্সট্রুডার মেশিন, ফেব্রিক্সযুক্ত রাবার শীট প্রস্তুতের জন্য ক্যালেন্ডার মেশিন, মেটালযুক্ত রাবার আইটেম প্রসেসিং এর জন্য ব্লাস্টিং মেশিন, ভালকানাইজিং এর জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হাইড্রোলিক প্রেস সহ সব ধরনের যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়েছে। এখানে সেমি ফিনিশড রাবার প্রোডাক্ট ও ফিনিশড প্রোডাক্ট সমূহের সর্বোচ্চ গুনগতমান নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন ধরণের টেস্ট ইকুইপমেন্ট সহ পূর্ণাঙ্গ একটি ‘রাবার টেস্ট ল্যাব’ও স্থাপন করা হয়েছে। ফলে এ ফ্যাক্টরিটি ইতোমধ্যে বিশ^মানের একটি মেরিন রাবার উৎপাদন প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ইতোমধ্যে মোংলা বন্দরের জেটির জন্য সাফল্যজনক ভাবে প্রথম দেশীয় ‘রাবার ফেন্ডার’ উৎপাদন ও সংযোজন করেছে।
খুলনা শিপইয়ার্ড ইতোমধ্যে দেড় সহ¯্রাধিক কোটি টাকার দেশীয় তহবিলে শরিয়তপুরের নড়িয়া ও বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি প্রকল্প সাফল্যজনকভাবে বাস্তবায়ন করেছে ।
এসব বিষয়ে খুলনা শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমোডর এম শামসুল আজিজ-এনজিপি, পিএসসি-বিএন জানান, কর্তব্য পরায়নতা ও সততার সাথে আন্তরিকভাবে কাজ করার ফলেই যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই খুলনা শিপইয়ার্ড এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনে খুলনা শিপইয়ার্ড আরো বড় ধরনের নৌযান নির্মানের মধ্যেমে সাফল্যের উচ্চ শিখরে পৌঁছবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT