বুধবার মধ্যরাত থেকে সারাদেশে ইলিশ আহরণ পরিবহন ও বিপননে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা বুধবার মধ্যরাত থেকে সারাদেশে ইলিশ আহরণ পরিবহন ও বিপননে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা - ajkerparibartan.com
বুধবার মধ্যরাত থেকে সারাদেশে ইলিশ আহরণ পরিবহন ও বিপননে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা

3:49 pm , October 10, 2023

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ ইলিশের প্রজনন নির্বিঘেœর মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বুধবার মধ্যরাত থেকে দেশের উপকূলের ৭ হাজার ৩৪২ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ২২ দিনের জন্য সব ধরনের মৎস্য আহরণ সহ সারাদেশেই ইলিশের পরিবহন ও বিপননে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হচ্ছে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে ইতোপূর্বে আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে পরের ২২ দিন এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশের প্রজনন সময় কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করে এসময় কিছুটা আগে-পিছে করতে হচ্ছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে। আগামী ২ নভেম্বর পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে সারাদেশের মত দক্ষিণাঞ্চল সহ উপকূলভাগে পুলিশের পাশাপাশি নৌ পুলিশ, কোষ্টগার্ড, র‌্যাব এবং বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নদ-নদী সমূহে নজরদারী শুরু করছে। এলক্ষ্যে বরিশাল বিভাগীয় সদর থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়েছে।
টানা ২২ দিন ইলিশ আহরণে বিরত উপকূলের বিশাল জেলে সম্প্রদায়ের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে আগামী সপ্তাহেই উপকূলের ৩৭টি জেলার ১৫৫টি উপজেলার ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮৭টি জেলে পরিবারের মাঝে ২৫ কেজি করে সর্বমোট ১৩ হাজার ৮৭২ টন চাল বিতরণ করবে সরকার। এরমধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগের ৩ লাখ ৭ হাজার ৮৪১ জেলে পরিবারের মধ্যে প্রায় ৭ হাজার ৭শ’ টন চাল বিতরণ করা হবে ।
আশ্বিনের ভরা মৌসুমে ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার উত্তর তজুমদ্দিন থেকে পশ্চিম সৈয়দ আউলিয়া পয়েন্ট, কলাপাড়ার লতাচাপলি পয়েন্ট এবং লাতাচাপলী ইউনিয়নের লেবুর বাগান পয়েন্ট, মঠবাড়ীয়ার সাপলেজা সংলগ্ন ভাইজোড়া পয়েন্ট, শরণখোলার পক্ষীর চর ও বগী এলাকা, শাহেরখালী থেকে হাতিকন্দি ও উত্তর কুতুবদিয়া থেকে গন্ডামারা পয়েন্টে মা ইলিশের অত্যাধিক প্রাচুর্য্য লক্ষ্য করা গেছে। এ কারণে ৭ হাজার ৩৪২ বর্গ কিলোমিটারে আগামী ২২ দিনের জন্য সব ধরনের মৎস্য আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকছে ।
‘হিলসা ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্লান’-এর আওতায় ২০০৫ সালেই সর্বপ্রথম প্রধান প্রজনন মৌসুমে ১০ দিন ইলিশের আহরণ বন্ধ রাখা হয়।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের সুপারিশে ২০১১ সালে তা ১১ দিন এবং ২০১৫ সালে ১৫ দিন ও ২০১৬ সালে থেকে ২২ দিনে উন্নীত করা হয়। ইলিশ নিয়ে নানামুখী বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশে ইলিশের উৎপাদন এক সময়ের ১.৯৮ লাখ টন থেকে ২০২১-২২ সালে ৫.৬৬ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে। গত অর্থ বছরে তা ৫.৬৬ লাখ টনে উন্নীত হয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে। এরমধ্যে বরিশাল বিভাগে গত অর্থ বছরে আগের বছরে চেয়ে প্রায় ১৪ হাজার টন বেশী ৩.৮৪ লাখ টন ইলিশ উৎপাদান ও আহরণ হয়েছে বলে মৎস্য দপ্তর জানিয়েছে। আমাদের অর্থনীতিতে জাতীয় মাছ ইলিশের একক অবদান ১%-এর বেশী। আর মৎস্য খাতে প্রায় ১২.৫০%। সারাবিশে^র ৬০%-এরও বেশী ইলিশ এখন বাংলাদেশেই উৎপাদন হচ্ছে।
প্রতিদিন ¯্রােতের বিপরীতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলা অভিপ্রয়াণী মাছ, ইলিশ জীবনচক্রে স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, উপকূলের ৭ হাজার ৩৪২ বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্ত ভাসমান অবস্থায় ছাড়া ডিম থেকে ফুটে ইলিশের লার্ভা, স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্র সমূহে বিচরণ করে খাবার খেয়ে বড় হতে থাকে। নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে ৭-১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়াবার পরে পরিপক্কতা অর্জনে জাটকা হিসেব সমুদ্রে চলে যায়। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২-১৮ মাস অবস্থানের পরে পরিপক্ক হয়েই পূর্র্ণাঙ্গ ইলিশ হিসেবে প্রজননের লক্ষ্যে আশি^নের বড় পূর্ণিমা ও পরবর্তী অমাবস্যার সময়ে আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের ইকোসিস্টেমে সারা বছরই ৩০% ইলিশ ডিম বহন করে। বাকি ৭০% আশি^নের বড় পূর্ণিমা ও অমাবশ্যার আগে পরে ডিম ছাড়ছে। যে ডিমগুলো পুরুষ ইলিশ দ্বারা নিষিক্ত হয়ে থাকে তা নতুন প্রজন্ম গঠন করে। ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র ও মাইগ্রেশন পথ নির্বিঘœ রাখা সহ সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের মজুদ ও জীব বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করতে ২০১৯ সালে নিঝুম দ্বীপ সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে দেশের প্রথম ‘সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা বা মেরিন রিজার্ভ এরিয়া’ ঘোষণা করা হয়েছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮-এর প্রজননকালে উপকূলের প্রজননস্থল সহ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ৪৮% মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পায়। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর মতে প্রজননক্ষম মা ইলিশের হার ২০১৭ সালে ৭৩% থেকে ’১৮ সালে ৯৩%-এ উন্নীত হয়। পাশাপাশি এসময়ে প্রজনন সাফল্য ৮০%-উন্নীত হয়। ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধের ফলে ওই সময়ে দেশে ৭ লাখ ৬ হাজার কেজি উৎপাদিত ডিমের ৫০%-এর সাফল্যজনক পরিস্ফূটন সহ তার ১০% বেঁচে থাকলেও ইলিশ পরিবারে নতুন ৩ হাজার কোটি জাটকা যুক্ত হয়।
এমনকি ২০১৯ সালে মূল প্রজননকালীন সময়ে দেশের প্রধান ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্র সমূহে পরীক্ষামূলক নমুনায়নে ৮৩% ইলিশের রেনু পাওয়া যায়। সে সময়ে ওই সব এলাকায় ১৭% অন্যান্য মাছের রেনুও পোনা পাওয়া গেছে। ফলে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালীন সময়ে উপকূলে অন্যান্য মাছেরও নিরাপদ প্রজনন স¤পন্ন হচ্ছে। যা দেশে অন্যান্য মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতেও যথেষ্ট সহায়ক হচ্ছে বলেও জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর।
গত বছরও ২২ দিনের মূল প্রজনন সময়ে দক্ষিণ উপকূল সহ সংলগ্ন অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে প্রায় ৮৪% মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। এরমধ্যে ৫২ ভাগ মা ইলিশ মূল প্রজননকালীন সময়ে এবং অপর ৩২% ডিম ছাড়ারত ছিল। যা ছিল আগের বছরের প্রজননকালের চেয়ে প্রায় ২.৪৫% বেশী। মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদের মতে, গত বছর প্রজননকালে প্রায় ৮ লাখ ৫ হাজার কেজি ডিম ছেড়েছে মা ইলিশ। যার প্রস্ফূটনে দেশে ৪০ হাজার ২৭৬ কোটি জাটকা ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছে বলে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মনে করছে।
আগামী ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনের আহরণ, পরিবহন ও বিপনন নিষিদ্ধকালীন সময়ে দেশের সব ইলিশ মোকাম ছাড়াও বাজার এবং আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়কেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নজরদারী সহ অভিযান পরিচালনার সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT