3:45 pm , October 9, 2023
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ মৎস্য সম্পদে উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলে কোন ধরনের গবেষণা প্রতিষ্ঠান না থাকার মধ্যেই খেপুপাড়ার গঙ্গামতিতে একটি ‘মেরিন ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যলয়। প্রকল্পটি অনুমোদন ও বাস্তবায়িত হলে দেশে এটিই হবে এ ধরনের প্রথম মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান। প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সুপারিশ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সহ একটি ‘উন্নয়ন প্রকল্প-সারপত্র, ডিপিপি’ পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদিত হলে তা সারাদেশের মত সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশিচমাঞ্চলের মৎস্য সেক্টরের উন্ননে গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা রাখবে বলে মনে করছেন মৎস্য বিজ্ঞানীগন। প্রকল্প প্রস্তাবনাটি পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি ও কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির অনুমোদন পেলে জাতীয় অর্থনৈতিক কমিটির নির্বাহী কমিটি-একনেক’এর বিবেচনার জন্য উপস্থাপিত হতে পারে বলে জানা গেছে।
বিশ^বিদ্যালয়ের মৎস্য অনুষদের অধ্যাপক ড. শামিম জানিয়েছেন প্রকল্পটির আওতায় গঙ্গামতির চরে ১শ’ একর জমির ওপর ইনস্টিটিউটটি গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে। ইনস্টিটিউটটির আওতায় গবেষণা নৌযানের পাশাপাশি সী ট্রেনিং সেন্টার, সী এ্যাকুরিয়াম, পানি শোধনাগার ছাড়াও একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন এবং ছাত্র-শিক্ষকদের আবাসন সুবিধার পাশাপাশি গবেষণা কাজে প্রয়োজনীয় সব সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। প্রাথমিকভাবে ‘মেরিন ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট’এ ৩০ জন করে ছাত্র-ছাত্রী ফিশারিজ-এর ওপর উচ্চতর পড়াশোনার সুযোগ পাবেন। পরবর্তীতে সংখ্যাটা আরো বৃদ্ধিরও পরিকল্পনা থাকছে বলেও জানিয়েছেন ড. শামিম। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে গঙ্গামতির চর এলাকার সবুজ নয়নাভিরাম প্রকৃতিক পরিবেশে প্রস্তাবিত এ ‘মেরিন ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট’টি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সেরা ল্যাব সুবিধা সমৃদ্ধ একটি মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আদলে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েই কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমানাজুড়ে বিস্তীর্ণ জলরাশির সঞ্চালন সুনীল ঢেউ-এর মাথায় যে রূপালী উর্মিমালা আলিঙ্গন করছে, বিশ্ব মানচিত্রে তা-ই বঙ্গোপসাগর। পৃথিবীর অন্যসব সাগরের মতই প্রকৃতির সব লীলার সঙ্গিনী হয়ে মেতে আছে আমাদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বঙ্গোপসাগরও। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যপূর্ণ মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বিশে^র একমাত্র উপসাগর, যেখানে সবচেয়ে বেশী নদী বিধৌত পানি প্রবাহিত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিশ^ব্যাপী ‘সামুদ্রিক ও উপকূলীয় মৎস্য সম্পদ অতি আহরণ, ভূমি ও সমুদ্র হতে সৃষ্ট দূষণ এবং জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন সহ নানামুখী সংকটের সম্মুখীন’। ফলে বাংলাদেশের মত বিশে^র মৎস্যকূলের প্রাচুর্য, বিস্তৃতি ও প্রজাতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। প্রস্তাবিত মেরিন ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটটি বঙ্গোপসাগরের জীব বৈচিত্র রক্ষা সহ মৎস্য সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতেও ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ আমাদের বঙ্গোপসাগর বিশে^র মৎস্য বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে মাছের এক গুরুত্বপূর্ণ আধার। বঙ্গোপসাগরে আমাদের একান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে মলাস্কা বা শামুক ও ঝিনুক প্রজাতির সংখ্যা ৩০১ টি, অস্থিময় মাছ ৪৭৫টি, হাঙ্গর ও স্কেট সহ তরুনস্থিময় মাছের প্রজাতি ৫১টি, চিংড়ি ৩৬টি, লবস্টার ৮টি, কাঁকড়া ১৫টি, ডলফিন বা তিমি ১১টি, সামুদ্রিক কচ্ছপ ৫টি, সাপ ৯৮টি সেপালোপেড ৭টি, স্টার ফিশ ৩টি, অয়েস্টার ৬টি, সজারু ১টি, সাগর শশা ১টি এবং ১৬৮ প্রজাতির শৈবাল, ১৩ প্রজাতির প্রবাল ও ৩ প্রজাতির স্পঞ্জ রয়েছে।
কিন্তু যুগের পর যুগ ধরে অনিয়ন্ত্রিত আহরণের ফলে সাগরে ফলি, চান্দা, সার্ডিন বা চাপিলা, বস্তার পোয়া প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। লাক্ষা মাছও অতিরিক্ত আহরণে প্রায় নিঃশেষ। মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, এ অবস্থায় যেকোন মাছ বাণিজ্যিকভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবার প্রবল ঝুঁকি থাকে। কার্যকর সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এসব প্রজাতির মাছ সম্পূর্ণ বিলুপ্তির আশংকার কথাও জানিয়েছেন মৎস্য বিজ্ঞানীরা। তবে রূপচাঁদা, কলম্বো, মরিচ এবং সাদা পোয়া মাছ এখনো সহনীয় আহরণে তার অস্তিত্ব ধরে রেখেছে। আন্তর্জাতিক পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে একজন মানুষের দৈনন্দিন ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদার বিপরীতে আমাদের দেশে তা ইতোমধ্যে ৬২.৫৮ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। বরিশাল অঞ্চলে তা আরো বেশী বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে। ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৮’ এর হিসেব অনুযায়ী, দেশের মোট জিডিপি’র ৩.৫৭% এবং কৃষিজ জিডিপি’র ২৫.৩০% মৎস্যখাতের অবদান। দক্ষিণাঞ্চলে এ হার আরো বেশী বলে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। অধিদপ্তরের মতে, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশের বেশী মানুষ মৎস্য সেক্টর থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। ২০১৬-১৭ সালে দেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও আরো ৫ বছর আগেই দক্ষিণাঞ্চল এখাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। এমনকি নানা সীমাবদ্ধতায়ও গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে মাছের উৎপাদন প্রায় ৭৫% বৃদ্ধি পেয়ে ৩ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে এখন প্রায় ২.৩৫ লাখ টন উদ্বৃত্ত এলাকা। গত এক দশকে দেশে মাছের উৎপাদন ৫৩% বাড়লেও প্রায় ১১ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলে মৎস্যখাতে প্রবৃদ্ধির হার ৭৫%। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১১২%। এমনকি সারা দেশে ইলিশের ৬৬%-ই আহরিত হয় দক্ষিণাঞ্চলের অভ্যন্তরীন নদ-নদী সহ বঙ্গোপসাগর ও সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায়। প্রস্তাবিত মেরিন ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট উপকূলবাগের ইলিশ সহ প্রতিটি প্রজাতির মাছ সংরক্ষন ও এর সহনীয় আহরণ সহ উন্নয়নের বিষয়েও গবেষনা ধর্মী পরামর্শ প্রদান করবে বলে আশা করা হচ্ছে।