3:41 pm , October 8, 2023
জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি উজানে নদ-নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রন, নাব্যতা সংকট বৃদ্ধি সহ বর্জ্য অপসারণ না করার ফলে
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি উজানে নদ-নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রনে দ্রুত নাব্যতা সংকট বৃদ্ধি সহ বর্জ্য অপসারন না করার ফলে চলতি বছর বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চল ও সংলগ্ন উপকূলভাগে ইলিশের বিচরনস্থলে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, ইলিশ উৎপাদনের ক্রমবর্ধনশীল ধারায় এখনো বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়লেও ভবিষ্যতে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক নানা সমস্যা বিরুপ পরিস্থিতি তৈরী করতে পারে। বিচরনস্থলে নানামুখি বিরুপ প্রভাবে এবার ইলিশের গতিপথ ও আবাসস্থলের কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চল সহ সংলগ্ন উপকূলভাগে এতদিন ইলিশের বিচরন কম থাকায় আহরণও কিছুটা কম। ফলে বাজারে সরবরাহ ঘাটতির সাথে মূল্যও আকাশচুম্বি। বরিশালের খুচরা বাজারে সাড়ে ৮শ গ্রাম থেকে ১ কেজি সাইজের ইলিশ বিক্রী হচ্ছে সাড়ে ১২শ থেকে ১৪শ টাকা কেজি। এমনকি খুব সহসাই ইলিশের অবাধ ও সুস্থ বিচরন সহ প্রজনন ক্ষেত্রে উন্নতি ঘটাতে না পারলে আগামীতে উৎপাদনেও বিরুপ প্রভাব সৃষ্টির আশংকার কথা বলেছেন একাধিক মৎস্য বিজ্ঞানী। তবে গত সপ্তাহ থেকে বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী ও বরগুনার অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে মাঝারী সাইজের কিছু ইলিশ ধরা পড়তে শুরু করেছে। আর এসব ইলিশও পেটে ডিম নিয়ে সাগর থেকে দক্ষিণ উপকূল সহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে উঠে আসছে বলে জানিয়েছেন মৎস্যজীবী ও জেলেরা। কিন্তু প্রজনন নিশ্চিত করতে আগামী ১১ অক্টোবর দিবাগত মধ্যরাত থেকে ২ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত উপকূলের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন স্থলসহ সারাদেশে ইলিশ আহরণ, পরিবহন ও বিপনন নিষিদ্ধ থাকছে।
গত প্রায় দেড়মাস লাগাতার আবহাওয়া দূর্যোগপূর্ণ থাকায় ছোট থেকে মাঝারী ট্রলারগুলো সাগরে যেতে পারছে না। ফলে বাজারে ইলিশের সরবরাহ সংকট আরো কিছুটা বেড়েছে বলে মনে করছেন মৎস্যজীবীরা।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, এবার মূল বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি সহ জীব বৈচিত্রের নানা পরিবর্তনের সাথে হাইড্রো-মেট্রোলজিক্যাল নানা সমস্যায় ইলিশের বিচরন পরিবর্তন হচ্ছে। ইতোপূর্বে খেপুপাড়া, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, মনপুরা,ঢালচর, চরকুকরী-মুকরি, চর কচ্ছপিয়া ও সংলগ্ন এলাকায় ইলিশের যে বিচরন ছিল, এবার তা অনেকটাই পূর্ব-দক্ষিনে সন্দ্বীপের দক্ষিন হয়ে টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন এলাকায় সরে গেছে। এর পেছনে উজানে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের সাথে সময়মত বৃষ্টিপাতের অভাবে পদ্মা-মেঘনা ও এর শাখা নদ-নদীগুলোতে প্রবাহ হ্রাস এবং পানির দূষণও কাজ করছে বলে মৎস্য বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলে কোন বৃষ্টি হয়নি। এপ্রিলে স্বাভাবিকের তুলনায় কিছু বেশী বৃষ্টি হলেও জুন-জুলাইতে তা ছিল স্বাভাবিকের কম। এমনকি ভরা বর্ষা মৌসুমের জুলাই মাসে বরিশালে বৃষ্টিপাতের পরিমান ছিল স্বাভাবিকের ৫৮% কম। কিন্তু আগস্টে ৮০% এবং সেপ্টেম্বরে প্রায় ১২% বেশী বৃষ্টি হয়েছে। আর চলতি অক্টোবরে বরিশালে স্বাভাবিক ১৭৬ মিলিমিটারের স্থলে আবহাওয়া বিভাগ থেকে ১৬০-২১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দেয়া হলেও ১ অক্টোবর সকাল থেকে ৮ অক্টোবর সকাল পর্যন্ত ২৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে।
মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আশরাফুল আলম জানান, চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনা ও ডাকাতিয়ার মোহনায় যে ¯্রােত অতীতে ছিল এবার বর্ষা মৌসুমে স্বভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাব সহ উজানে প্রবাহ নিয়ন্ত্রনের ফলে তা লক্ষ্য করা যায়নি। উপরন্তু চাঁদপুর থেকে সাগর মোহনা পর্যন্ত দেড়শর’ও বেশী ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ইলিশের গতিপথ রুদ্ধ হচ্ছে। আবার যেখানে নদীর গভীরতা বেশী সেখানে নৌপথের মূল চ্যানেল হওয়ায় জেলেরা জাল ফেলতে পারছে না। তবে মূল বর্ষা মৌসুমে ঘাটতির পরে গত দু মাস যে বাড়তি বৃষ্টি হচ্ছে তা ইলিশ সহ উম্মুক্ত জলাশয়ের মাছের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করেন তিনি।
ড. আশরাফুল আলমের মতে, অতিমাত্রায় শিল্প ও মনুষ্য বর্জ্য অপসারণের ফলে নদ-নদীতে ইলিশের প্রধান খাবার ফাইটোপ্লাঙ্কটন ও জু-প্লাঙ্কটনের ঘাটতি প্রকট আকার ধারন করছে। যেখানে প্রতি লিটার পানিতে ফাইটো প্লাঙ্কটন ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার থাকার কথা, সেখানে তা দেড় হাজারের নিচে এবং জিও প্লাঙ্কটন ১৫শর স্থলে কোন কোন নদীতে ২-৩শতে নেমে এসেছে। ফলে খাবারের অভাবেও ইলিশ সাগরের উপকূল অতিক্রম করে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে আসছেনা। পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে অতিরিক্ত তাপ প্রবাহের ফলেও ইলিশ সাগর থেকে নদীমুখি হচ্ছে না। ইলিশ বিচরনের জন্য যেখানে অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানির তাপমাত্রা ২৮-৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস থাকা প্রয়োজন সেখানে তা ৩৪-৩৫ ডিগ্রী অতিক্রম করছে বলেও জানান তিনি।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, জীবনচক্রে অভিপ্রয়াণী মাছ ইলিশ স্বাদু পানি থেকে সমুদ্রের নোনা পানিতে এবং সেখান থেকে পুনরায় স্বাদু পানিতে অভিপ্রয়াণ করে। একটি পূর্ণাঙ্গ ইলিশ প্রতিদিন ¯্রােতের বিপরীতে ৭১ কিলোমিটার পর্যন্ত ছুটে চলতে সক্ষম। উপকূলের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারের মূল প্রজনন ক্ষেত্রে মুক্তভাবে ভাসমান ডিম ছাড়ার পরে তা থেকে ফুটে বের হয়ে ইলিশের লার্ভা স্বাদু পানি ও নোনা পানির নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে বিচরন করে থাকে। এরা খাবার খেয়ে নার্সারী ক্ষেত্রসমূহে ৭Ñ১০ সপ্তাহ ভেসে বেড়িয়ে জাটকা হিসেব কিছুটা বড় হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পরিপক্কতা অর্জন করে। বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ১২Ñ১৮ মাস অবস্থানে প্রজননক্ষম হয়ে ইলিশ আবার স্বাদু পানির নার্সারী ক্ষেত্রে ফিরে এসে ডিম ছাড়ে। গত কয়েক দিন ধরে বরিশাল সহ দক্ষিণ উপকূলের বিভিন্ন নদ-নদীতে মাঝারী সাইজের যে ডিমওয়ালা ইলিশ উঠে আসছে, তা মূলত গত বছর মা ইলিশের ছাড়া ডিম থেকে ফোটানো বাচ্চা বলে মনে করছেন মৎস্য বিজ্ঞানীরা।
গত বছর দক্ষিণ উপকূল সহ সংলগ্ন অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে প্রায় ৮৪% মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। এরমধ্যে ৫২ ভাগ মা ইলিশ ২২ দিনের মূল প্রজননকালীন সময়ে এবং পরবর্তিতে ৩২% ডিম ছাড়ারত ছিল। যা ছিল অগের বছরের প্রজননকালের চেয়ে প্রায় ২.৪৫% বেশী। মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর মতে, গত বছর প্রজননকালে প্রায় ৮ লাখ ৫ হাজার কেজি ডিম ছেড়েছে মা ইলিশ। যার প্রস্ফূটনে দেশে ৪০ হাজার ২৭৬ কোটি জাটকা ইলিশ পরিবারে যুক্ত হয়েছে বলে মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানিয়েছেন।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যলয়ের মৎস্য অনুষদের অধ্যাপক ড. সাজেদুল ইসলামও মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট-এর বিজ্ঞানীদের সাথে একমত পোষন করে ইলিশের বংশ বিস্তার সহ নদ-নদীর হাইড্রো-মেট্রোলজিক্যাল বিষয়গুলোর প্রতি নজরদারীর আহবান জানিয়েছেন।