অবৈধ অটো রিকশার দাপটে বিলুপ্ত প্রায় প্যাডেল রিকশা অবৈধ অটো রিকশার দাপটে বিলুপ্ত প্রায় প্যাডেল রিকশা - ajkerparibartan.com
অবৈধ অটো রিকশার দাপটে বিলুপ্ত প্রায় প্যাডেল রিকশা

3:59 pm , September 27, 2023

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ আশির দশকেও বরিশাল পৌরসভার আয়তন যখন মাত্র ২৩ বর্গ কিলোমিটার তখন বরিশাল শহরে প্রায় তিন হাজার প্যাডেল চালিত রিকশা চলাচল করেছে। আর এখন হাতেগোনা ২০ থেকে ৫০টি রিকশা খুঁজে পাওয়া যাবে বরিশাল নগরীতে। নগরবাসীর দাবি আর কিছুদিন পর এগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। অবৈধ অটোরিকশা জায়গা দখল করে নেবে। এমনিতেই চারিদিকে অবৈধদের দাপট সবখানে। আর প্রশাসন বলছে খুব শীঘ্রই নতুন নীতিমালা হবে বরিশাল সিটি করপোরেশনের।
২০০২ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশন হবার পর এই শহরটি রাতারাতি রিকশার শহর হিসেবে পরিচিতি পায়।  সেই সময় যন্ত্র চালিত যানবাহন বলতে তিন চাকার ব্যাবিট্যাক্সি চলাচল করতো। তবে তা ছিলো সবমিলিয়ে ৩০ থেকে ৫০টির বেশি নয়। ২০০৬ সালের পর শহরে একটু একটু করে প্রথমে মাহিন্দ্রা চলাচল শুরু হয় এবং ব্যাবিট্যাক্সিগুলো তুলে দেয়া হয়। তখনও বরিশাল শহরের মানুষের প্রধান যানবাহন ছিলো পায়েচালিত রিকশা।  দিন যত যায় রিকশা ভাড়া ততই বাড়তে থাকে। এ নিয়ে রিকশাচালকদের সাথে সাধারণ মানুষের তর্কের শেষ ছিলোনা। প্যাডেল বা পায়ে চালিত রিকশা নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শিক্ষক নেতা ফরিদুল আলম জাহাঙ্গীর তালুকদার বলেন, আমি এবং আমার সহধর্মিণী দুজনেই তখন নদীর ওপারে তালুকদার হাট স্কুল এন্ড কলেজে চাকরি করতাম। নৌকা পার হয়ে ইট বিছানো সড়কে পায়ে চালিত রিকশায় চড়ে তালুকদারহাট আসা-যাওয়া করতাম। একটা অন্য রকম আনন্দ ছিলো সেই পথটুকু চলায়। আজ সবকিছু বদলে গেছে। যন্ত্রচালিত, ব্যাটারিচালিত যানবাহনের মতোই মানুষেরাও এখন সবকিছু শর্টকাট করে ফেলছে।
সিটি করপোরেশন হওয়ার পরপরই বরিশাল শহরের আয়তন বৃদ্ধি হয়েছে।  এখন ৫৮ বর্গকিলোমিটার বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকায় রিকশার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হলে বিসিসির প্রথম মেয়র মজিবর রহমান সরোয়ার হাজারখানেক রিকশা মালিকানা করে দেন। মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, ওই সময় সিএনজি আসেনি। ১৫০টির মতো ব্যাবিট্যাক্সি হবে। সিএনজি যখন এসেছে তখন আমি এমপি ছিলাম।
২০১২ সালে নগরীতে ইজিবাইক, অটোরিকশা ও সিএনজি চলাচল বৃদ্ধি পেতে শুরু করে বলে জানালেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক পরিবহন বিভাগের কর্মকর্তা মাইনুল। তিনি বলেন, তখন মেয়র শওকত হোসেন হিরণ এসে এগুলোকে একটা নিয়মের মধ্যে এনে দেন এবং ২৬১০টি যানবাহন নগরীতে চলাচলের অনুমতি পায়। অটোরিকশা ও ইজিবাইক তখন অল্প কিছু, পায়ে চালিত রিকশা তখনও অনেক ছিলো।  মূলত করোনাকালীন সংকট সময়ের পরই নগরীতে ইজিবাইক, অটোরিকশা ও সিএনজি বাড়তে শুরু করেছে বলে জানান তিনি।
বরিশালে জনসংখ্যার সাথে পাল্লা দিয়ে যেমন বেকারত্ব বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে অটোরিকশা। দুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকলেও এটিই এখন কর্ম হারানো মানুষের প্রথম পছন্দ। বরিশালসহ আশপাশের ছয় জেলার প্রায় সব উপজেলা ও ইউনিয়নেই বেড়েছে এই ইজিবাইক ও অটোরিকশা। অদক্ষ ও অপ্রাপ্ত বয়স্করা ব্যাটারিচালিত এই রিকশা চালিয়ে বিভিন্ন দুর্ঘটনার কবলেও পড়ছে তারা। যাত্রীদেরও ক্ষতি কম হয়নি। তারপরও দ্রুত গতি চায় প্রায় সবাই। তবে ওই সব অটোরিকশা চালকদের ভাষ্য, করোনাকালীন সময়ে  চাকরি হারিয়ে এই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক আমাদের আশ্রয় হয়েছে। এখন এই রিকশা চালিয়ে কোনো রকম খেয়েপড়ে বেঁচে আছেন তারা।
নগরবাসী, সিটি করপোরেশন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধির বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আসার পর তা প্যাডেল রিকশার জায়গা পুরোটাই দখল করে নিয়েছে। বছর চারেক আগেও বরিশাল নগরীর মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিল রিকশা। বর্তমান সময়ে বরিশাল নগরীতে শুধুমাত্র সদর রোডে পায়ে চালিত রিকশা চোখে পড়ে। কেননা, শহীদ মিনার থেকে বিবির পুকুর পাড় এবং কাকলী মোড় থেকে ফজলুল হক এভিনিউতে ইজিবাইক ও অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ। ফলে এটুকু পথে পায়ে চালিত রিকশার বিকল্প নেই।   অথচ এক সময় বরিশাল নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক ও আনাচে-কানাচে পায়ে চালিত  রিকশার ছড়াছড়ি ছিলো। রিকশার প্যাডেল ঘুরিয়ে সংসার চলত শত শত মানুষের। বর্তমানে নগরীসহ গোটা বরিশাল বিভাগজুড়েও খুব একটা দেখা মেলে না প্যাডেল রিকশার। নগরীর মধ্যে যেসব প্যাডেল চালিত রিকশা চলাচল করে সেগুলোর চালকরাও বেশ বয়স্ক। তারা তাদের পেশিশক্তি দিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ঠু করতে পারেন না যাত্রীদের।
নগরীর সদর রোডে দেখা হলো রিকশাচালক মোতালেব ফকিরের (৫৬) সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৯ বছর ধরে বরিশাল শহরে রিকশা চালাই। এখনো চালিয়ে যাচ্ছি। ৭-৮ বছর আগেও প্রতিদিন ৭০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা আয় করতাম। এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে ৩০০  থেকে  সাড়ে ৩০০ টাকা আয় হয়। কোনো কোনো দিন সেটা হয়ও না। মানুষ এখন আর রিকশায় উঠতে চায় না। অটোরিকশা কেনার টাকা নেই। এজন্য বাধ্য হয়ে প্যাডেল রিকশাই চালাতে হয়। নতুন বাজার এলাকার রিকশাচালক সুফিয়ান ভূঁইয়া (৫৮) বলেন, এখন মানুষ অলস হয়ে গেছে। মানুষের সময় কমে গেছে। কেউ রিকশায় চড়ে দূরে কোথাও যেতে চায় না। দিন-রাত খেটে যে টাকা আয় করি তা দিয়ে সংসার চলে না। দীর্ঘদিন ধরে রিকশা চালিয়ে আসছি। এটা ছেড়ে দিয়ে এখন অন্য কোনো পেশায় যাব তারও উপায় নেই।
নগরীর একাধিক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, ৫-৭ বছর আগে বাজার করাসহ বিভিন্ন কাজে বের হলে শহরে রিকশাতেই ঘুরে বেড়াতাম। তাছাড়া সেই সময় এতো মোটরসাইকেলের ব্যবহার ছিল না। অধিকাংশ মানুষ বাসা থেকে বের হয়ে প্যাডেল রিকশায় চড়েই অফিস, আদালত ও দোকানপাটে পৌঁছাতেন। ভালো ছিল সেই দিনগুলো। তারা বলেন, মানুষের মধ্যে অলসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অটো চালকরা পায়ের উপর পা তুলে অটো চালায়। এতে দুর্ঘটনাও ঘটে। শহরে এখন যেই সংখ্যক ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করে তাতে এখান থেকে প্যাডেল রিকশা-ভ্যান বিলুপ্ত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বরিশাল ট্রাফিক বিভাগের হিসাবে নগরীতে ১২ হাজারের বেশি অবৈধ যানবাহন চলাচল করছে। প্রতিদিন গড়ে ১০টি করে বাড়ছে অটোরিকশা।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ নগরীতে চলাচলের জন্য ৫ হাজার ইজিবাইক ও অটোরিকশা অনুমোদন স্টিকার  ও লাইসেন্স দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন শ্রমিক নেতা পরিমল চন্দ্র দাস। তবে বরিশালের নবনির্বাচিত মেয়র খোকন সেরনিয়াবাত বলেছেন, তিনি পরিকল্পিত নগরায়নে বিশ্বাসী। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি এ জন্য সুশীল সমাজের প্রতিনিধি নিয়ে বৈঠক করবেন এবং তাদের পরামর্শ নিয়ে  যানবাহনের নতুন নীতিমালা তৈরি করবেন।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT