আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ওহাব খান আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ওহাব খান - ajkerparibartan.com
আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ওহাব খান

4:19 pm , September 19, 2023

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বাবুগঞ্জ উপজেলা পরিষদের পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে ওহাব খান স্মৃতি পাঠাগার। ২০০৯ সালে তৈরি এ পাঠাগারের যে যথেষ্ট যতœ নেয়া হয় তা এর পরিচ্ছন্নতাই বলে দিচ্ছে। পাঠাগারের সামনে বিশাল পুকুরের বিপরীত পাশে একটি মসজিদ। এখানে উপজেলা পরিষদের দেয়াল ঘেঁষে বেশ কিছু দোকানঘর। হঠাৎ চোখ আটকে গেল দোকনঘরগুলোর সারিতে অনেকটা দোকান আদলেই পরে থাকা কবরটির দিকে। এটা কার কবর? পুকুর পাড়ে গল্পরত দুইজন ভদ্রলোক সেলিম জমাদ্দার ও  জহিরুল হক জানালেন, এটা বরিশালের বাবুগঞ্জের সাবেক চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ওহাব খান এর কবর। ওহাব খান নামটি বেশ পরিচিত। গুগল সার্চ দিতেই বেরিয়ে এলো বরিশালের গর্ব দুইজন ওহাব খানের নাম। যাদের একজন ঘুমিয়ে আছেন এখানে মুগ্ধতার ইতিহাস হয়ে। এখানে ঘুমিয়ে আছেন একজন বেইজ কমা-ার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল ওহাব খান। তাঁর জন্ম ১৯৪৩ সালে ২৬ জানুয়ারী বাবুগঞ্জ থানার দরিয়াবাদ গ্রামে। তার পিতা আসমত আলী খাঁ এবং মা মেহের নিগার। ওহাব খানের ছেলেবেলা কেটেছে চারিদিকে পানিবন্দী দরিয়াবাদ গ্রামে।  চাঁদপাশা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষার হাতে খড়ি। পরে শায়স্তাবাদ স্কুল থেকে ৮ম শ্রেণি ও বরিশাল সদরের আলেকান্দা নূরিয়া স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন ১৯৬০ সালে। এরপর বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ বা বিএম কলেজ থেকে  আইএ ও বিএ পাস করেন। তিনি পরবর্তীতে বরিশাল ল কলেজ থেকে এলএলবিও সম্পন্ন করেন। ওই সময় জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ওহাব খান এবং সভাপতি ছিলেন আমির হোসেন আমু। বাবুগঞ্জের সাবেক চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ওহাব খান স্বাধীনতা পূর্ব বরিশালে ৬০ এর দশকের একজন তুখোড় ছাত্রনেতা ছিলেন বলে পরিচয় উঠে আসে বিভিন্ন জনের বক্তব্যে।
১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সালের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন তিনি এবং তৎকালীন বরিশাল টাউনহলটিকে অশ্বিনী কুমার টাউনহল নামকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল বরিশাল পতনের পর তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সংগ্রহ করে চাঁদপাশা ইউনিয়ন পরিষদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযোদ্ধা ওহাব খান ঢাকা-বরিশাল সড়ক, রহমতপুর বিমানবন্দর, বাবুগঞ্জ-মুলাদী থানায় কয়েকটি যুদ্ধ পরিচালনা করে অপূর্ব সাহসের পরিচয় দেন। তিনি প্রথম সংগঠক যে ওই সময়ের আলোচিত রাজাকার শুক্কর আলীর বাড়িতে আক্রমণ চালান এবং তাকে হত্যা করেন। স্বাধীনতার পর তিনি ১৯৮৪ সালে বাবুগঞ্জ উপজেলার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালের ১৫ আগস্ট উপজেলা সদরে আততায়ীর হাতে  গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে খানপুরায় নিজ হাতে গড়া উপজেলা পরিষদের পাশেই দাফন করা হয়।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি দীর্ঘদিন চাঁদপাশা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তারই ছাত্র বর্তমান বরিশাল বিসিক শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, তখন আমি ৭ম শ্রেণির ছাত্র। একদিন ওহাব স্যার আমাদের সব ছাত্রদের ডেকে পরিত্যক্ত খেলার মাঠটি পরিষ্কার করালেন। আমরাতো মনে মনে খুব ক্ষুব্ধ হলাম। দুইমাস পরে দেখি ওই মাঠে আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। টানা তিনবছর স্যার ওই মাঠে আলুসহ অন্যান্য ফসলের চাষ করেন এবং ওই ফসল বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি স্কুল ভবন নির্মাণ করেন। এটাই বীর মুক্তিযোদ্ধা ওহাব খানের ভিন্নতা ছিলো।
মিজানুর রহমান বলেন, তাঁর পরিবারের সদস্যরা এখনো বরিশালে আছেন। তার বড় মেয়ে ফারজানা বিনতে ওহাব উপজেলার বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান।
ওহাব খানের বড় মেয়ে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ফারজানা বিনতে ওহাব বলেন, বাবা যখন মারা যান, আমরা তখন খুবই ছোট। তাই বাবার কর্মজীবন সম্পর্কে আমরা তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু বলতে পারবোনা। তবে তাদের সাথে আলাপে উঠে আসে বরিশালের বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান  ওমর বীরোত্তম, মহিউদ্দিন মানিক,
এনায়েত হোসেন চৌধুরী, আব্দুল মান্নান এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব
আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ, আমির হোসেন আমু, জাহাঙ্গীর কবির নানক এর নাম। যাদের সাথে ওহাব খানের সুসম্পর্ক ছিলো বলে জানান তার মেয়ে ফারজানা বিনতে ওহাব। ফারজানা বলেন, বরিশালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন এমন মানুষ যারা আছেন কিংবা তার সমসাময়িক গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা যারা ওহাব খানকে কাছ থেকে দেখেছেন এমন অনেকেই এখন আর জীবিত নেই। যারা আছেন তারা হয়তো বাবাকে জেনেছেন কাছ থেকেই। এই মানুষগুলোর হয়তো বলবেন কিছু, করবেন স্মৃতিচারণ।
ফারজানা বিনতে ওহাব এর দেখানো পথে হেঁটে যোগাযোগ হলো  চাঁদপাশা ইউনিয়নের দরিয়াবাদের মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল মোল্লা ও আব্দুল আলিম হাওলাদারের সাথে। জানা গেল যুদ্ধকালীন প্রশিক্ষণ ও ক্যাম্পের কথা। লাঠি দিয়ে কীভাবে তিনি প্রশিক্ষণ দিতেন তা জানালেন আরেক সহযোদ্ধা আব্দুল আলিম। ঘুরে দেখা হলো চাঁদপাশার দরিয়াবাদ গ্রামের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অস্ত্রাগারটিও। যা এখন অযতœ অবহেলায় অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে।  আর মরহুম ওহাব খানের চাচাতো ভাই মধু খানের মেঝ ছেলে মোশাররফ খান (ভাইস্তা) জানালেন, ছোটবেলা ও বিবাহিত জীবনের ব্যাক্তিগত কিছু তথ্য। ছাত্র রাজনীতি ও ঘনিষ্ঠজন আমির হোসেন আমু ও মহি উদ্দীন আহমেদের কথা। জানাগেল, ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামের আব্দুর রহমান সিকদারের মেয়ে নাইনু বেগম কে বিয়ে করেন ওহাব খান। একটু বেশি বয়সেই বিয়ে করছেন। সেখানে তাঁর দু কন্যা ফারজানা বিনতে ওহাব ও নাইমা খাতুন সুমনা। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম খালেদা ওহাব। সেখানে এক ছেলে নিয়াজ মোর্শেদ নাদিম এবং এক মেয়ে নাহিদা সুলতানা অনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান সিকদার মরহুম ওহাব খানের প্রথম স্ত্রীর বড় ভাই ছিলেন। আরো বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ও যুদ্ধকালীন তথ্য পাওয়া গেল মোশাররফ খানের কাছে।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT