4:10 pm , September 19, 2023

শাহ আলম বাদশা ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণপ্রকল্পের আওতায় দীর্ঘ ৩০ বছর পর নিজনামে জমির দলিলসহ ঘরের কাগজপত্র পেয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে যেন বাকরুদ্ধ ইটভাটার শ্রমিক মোকসেদুল। অন্যের ঘরেই নিজের জন্ম, এমনকি তার সন্তানের জন্মও অন্যের ঘরে। বাড়ি নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে। নতুন ঘরটি সাংবাদিকদের ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে মোকসেদুল বললেন, আধাপাকা ঘরটি তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে। থাকার ঘরের সঙ্গে রান্নাঘর। পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থাও ভালো। বিদ্যুৎ আছে, পানি আছে। পরিবার নিয়ে এখন খুব ভালোভাবে থাকতে পারবেন। আকলিমা নামের আরেক উপকারভোগী ঘরপ্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কলে যুক্ত হয়ে বলেন, মোর জায়গা-জমি ছিল না। ঘর দিছেন, জমি দিছেন। স্বামী-সন্তান নিয়া সুখে থাকিম। মুই খুব খুশি হইছো।
আশ্রয়ণ প্রকল্প বা আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়াধীন একটি সরকারি প্রকল্প, যার আওতায় ভূমিহীন, গৃহহীন এবং জমি থাকলেও ঘর নেই এমন পরিবারের জন্য বাসস্থান নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পটির লক্ষ্য উদ্দেশ্য হচ্ছে-ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল, অসহায় দরিদ্র-জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন, প্রশিক্ষণসহ ঋণপ্রদানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম করে তোলা এবং আয় বর্ধক কার্যক্রম সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ। দীর্ঘ ২১ বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হয়েই বঙ্গবন্ধুর জনবান্ধব কার্যক্রমগুলো আবার শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালে কক্সবাজারের সেন্টমার্টিনে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের পর একই বছর সারাদেশের গৃহহীন-ভূমিহীনদেরও পুনর্বাসনে শুরু হয় এই “আশ্রয়ণ প্রকল্প”। বিশ্বের কয়েকটি দেশে জমিক্রয়ের জন্য স্বল্পসুদে ঋণপ্রদানের নজির থাকলেও বিনামূল্যে ঘরসহ জমির মালিকানা দেয়ার ঘটনা বাংলাদেশে এটাই প্রথম ও সর্ববৃহৎ উদ্যোগ। উল্লেখ্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগ্রহে ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন নোয়াখালীর (বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলাস্থ) রামগতি উপজেলাধীন চরপোড়াগাছা গ্রামে ভূমিহীন-গৃহহীন ও ছিন্নমূলদের পুনর্বাসন-কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ফলে জনবান্ধব ও উন্নয়নমূলক এ কার্যক্রমগুলো স্থবির হয়ে পড়ে।
উন্নয়নের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে জলবায়ু উদ্বাস্তু, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গ, ভিক্ষুক, বেদে, দলিত, হরিজনসহ পিছিয়ে পড়া অন্যান্য সম্প্রদায়কেও জমিসহ ঘর প্রদান করা হচ্ছে। প্রকল্পের শুরু ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত শুধুমাত্র আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যারাক, ফ্ল্যাট, বিভিন্ন প্রকার ঘর এবং মুজিববর্ষের এককগৃহে মোট ৫ লক্ষ ৭ হাজার ২৪৪টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তাই অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে দারিদ্র্যবিমোচনের নতুন পদ্ধতিটি ইতোমধ্যে ‘শেখ হাসিনা মডেল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই মডেলের মূল ছয়টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন-উপার্জনক্ষমতা ও সঞ্চয় বৃদ্ধি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বীকরণ, সম্মানজনক জীবিকাসহ সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠাকরণ, নারীদের জমিসহ ঘরের অর্ধেক মালিকানা দিয়ে তাদের ক্ষমতায়িতকরণ, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়িয়ে মানবসম্পদ উন্নয়নকরণ, ব্যাপকহারে বনায়ন ও বৃক্ষরোপণ করে পরিবেশের উন্নতিসাধন এবং গ্রামের মধ্যই শহরের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকরণ। ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের’ মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল, অনগ্রসর ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে ২শতক জমির মালিকানাসহ সেমিপাকা এককঘর প্রদান করছেন। প্রতিঘরে বিনামূল্য বিদ্যুৎসংযোগ ও সুপেয় পানির সুব্যবস্থার মাধ্যমে উপকারভোগীদের আধুনিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে। উন্নয়নের মূলধারায় নারীদের সম্পৃক্ততাসহ ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণে বাড়িসহ জমির মালিকানা স্বামী-স্ত্রীর যৌথনামে দেয়া হচ্ছে। ফলে পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবনমান উন্নততর এবং পুনর্বাসিত পরিবারের সদস্যরা উৎপাদনমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সঞ্চয়ী হতেও উৎসাহিত হচ্ছে।
মুজিববর্ষে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনার আলোকে ভূমিহীন-গৃহহীনদের বাসস্থান নিশ্চিতকল্পে সেমিপাকা একক গৃহ নির্মাণ কর্মসূচিতে ঊপকারভোগীরা হলো (ক শ্রেণি) সকল ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল, অসহায় দরিদ্র পরিবার, (খ শ্রেণি) সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ জমির সংস্থান আছে, কিন্তু ঘর নেই এমন পরিবার। অগ্রাধিকারভিত্তিতে ‘ক’ শ্রেণির পরিবারের জন্য সরকারি নিষ্কন্টক খাসজমি, সরকারি ক্রয়কৃত জমি, সরকারের অনুকূলে দানকৃত জমি অথবা রিজিউমকৃত জমিতে ভূমিহীন-গৃহহীনদের পুনর্বাসন করা হচ্ছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে প্রকল্পটিতে সংযোজন করা হয় ৪০০ বর্গফুট আয়তনের ২ কক্ষ বিশিষ্ট সেমিপাকা একক গৃহ, যার মধ্যে রয়েছে সুপরিসর ২টি কক্ষের সামনে টানা-বারান্দা এবং পেছনে রান্নাঘর ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি পায়খানা। বিনামূল্যে বিদ্যুৎসংযোগের পাশাপাশি রয়েছে নিরাপদ সুপেয় পানির ব্যবস্থা। ক্লাস্টারভিত্তিক স্থাপিত গ্রামগুলোতে সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিনন্দন লে-আউটের মাধ্যমে অভ্যন্তরীন রাস্তা, কমিউনিটি সেন্টার, পুকুর, খেলার মাঠ প্রভৃতি নিশ্চিত করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রথম পর্যায়ে ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি ৬৩ হাজার ৯৯৯টি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে একই বছর ২০ জুন ৫৩ হাজার ৩৩০টি পরিবারকে জমির মালিকানাসহ ঘর প্রদান করা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে ৬৫ সহস্রাধিক ঘর নির্মাণাধীন রয়েছে। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩টি পরিবারকে জমিসহ সেমিপাকা একক ঘর প্রদানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়েছে। এক্ষেত্রে অচ্ছুতদের (কুষ্ঠরোগী) বান্দাবাড়ী আশ্রয়ণের মাধ্যমে পুনর্বাসন, তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) মানুষদের পুনর্বাসন, তিন পার্বত্যজেলায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠি পরিবারের জন্য বিশেষ ডিজাইনের গৃহনির্মাণ, দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলায় কয়লা খনির জন্য ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার-পুনর্বাসন, ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠির (রাখাইন) জন্য বিশেষ ডিজাইনের টংঘর নির্মাণ, হরিজন সম্প্রদায়ের পুনর্বাসন, ভিক্ষুক-পুনর্বাসনসহ দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
১৯৯৭ হতে ২০২২ সালের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ৫ লক্ষ ৭ হাজার ২৪৪টি ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবার পুনর্বাসিত হয়েছে। যেমন ১৯৯৭-২০০২ পর্যন্ত ব্যারাক-হাউজ নির্মাণের মাধ্যমে আশ্রয়ণ প্রকল্পে পুনর্বাসিত হয়েছে ৪৭ হাজার ২১০টি, ২০০২-২০১০ পর্যন্ত আশ্রয়ণ প্রকল্প ফেইজ-২ এ ৫৮ হাজার ৭০৩টি এবং ২০১০-২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পে ৬২ হাজার ১৩৫সহ সর্বমোট ১ লাখ ৬৮ হাজার ০৪৮টি পরিবার। নিজ জমিতেও গৃহ নির্মাণের মাধ্যমে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮৫৩টি, জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য কক্সবাজারের খুরুশকুলে নির্মিত বহুতল ভবনে ফ্ল্যাট হস্তান্তর ৬৪০টি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য বিশেষ ডিজাইনের ঘর ৬০০?টি, নদীভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে ১০০টি, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে এক হাজারটি এবং মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে চলতি অর্থবছরে দুকক্ষ বিশিষ্ট ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩টি সেমিপাকা একক ঘরসহ সর্বমোট ৫ লাখ ৭ হাজার ২৪৪টি ঘর প্রদান করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, মুজিববর্ষ উপলক্ষে বরিশাল সদর উপজেলার চরমোনাই ইউনিয়নের গিলাতলী গ্রামে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় যথাক্রমে ৫০ ও ৪০টি, আগৈলঝাড়ায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৩য় পর্যায়ে উপজেলার ৫টি ইউনিয়নে ৯৬টি পরিবারকে ঘর প্রদান করা হয়েছে।
লেখকঃ সিনিয়র তথ্য অফিসার, পিআইডি বরিশাল।