জিপসি বাইকে ছুটে চলা মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতীক এখনো তরতাজা যুবক জিপসি বাইকে ছুটে চলা মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতীক এখনো তরতাজা যুবক - ajkerparibartan.com
জিপসি বাইকে ছুটে চলা মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতীক এখনো তরতাজা যুবক

4:08 pm , September 18, 2023

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ আমরাই শুধু মুক্তিযুদ্ধ করিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর এদেশের বেশিরভাগ মানুষ মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিলো। তারা সরাসরি যুদ্ধ না করলেও তথ্য দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে, খাদ্য দিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রেখে বিভিন্নভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছিলো। যে কারণে আমি তাদেরও মুক্তিযোদ্ধা বলে মনে করি। কথাগুলো গর্বের সাথে বললেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সময়ের ৯ নং সেক্টরের সাবসেক্টর বরিশাল অঞ্চলের বীর মুক্তিযোদ্ধা কেএসএ মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতীক।
বছর তিনেক আগে মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতে গিয়ে এই মানুষটির সাথে আলাপ হয়েছিল । যুদ্ধকালীন সময়ের অনেকের গল্প বলেন তিনি। অত্যন্ত কৌশলে এড়িয়ে যান নিজের বীরপ্রতীক পরিচয়। ভালো লাগা বোধ থেকে এই মানুষটিকেই সভাপতি করে আমরা কয়েকজন গড়ে তুলি বরিশাল সাহিত্য সংসদ (বসাস)। তার থেকেই জানতে পারি প্রয়াত আব্দুল ওহাব খান, এসএম ইকবালসহ আরো অনেক আত্মত্যাগী মানুষের কথা। এদের মধ্যে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েও নিজের যোদ্ধা পরিচয় লুকিয়ে চরকাউয়া ইউনিয়নে বসবাস করেন বলে জানান মহিউদ্দিন মানিক। বরিশাল নগরীর পথে প্রান্তরে, মহাসড়ক ধরে কখনো বানারীপাড়া, বাবুগঞ্জ , গৌরনদীতে একটি জিপসি মোটরসাইকেল চালিয়ে ছুটে বেড়ানো পৌরাণিক যুবক তিনি এখনো। কখনো একা কখনো ভাগ্নি বা বন্ধুর কলেজা পড়ুয়া ছেলে-মেয়েকে বাড়ি পৌঁছে দিতে তার এই ছুটে চলা। জীবিত বা মৃত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার এবং আত্মীয় স্বজনদের বিপদে ছুটে এসে পাশে দাঁড়ানো এই মানুষটিকে কখনো কখনো দেখা যায় সরকারি অনুষ্ঠানগুলোতেও। তিনি নিজেও কিন্তু একজন যুদ্ধাহত বীর। তার কাছেও রয়েছে বীরপ্রতীক খেতাবের সনদ (নম্বর ৩৮৭, ১৯৭২)। তারপরও নিরহংকার এই ব্যক্তি চায়ের দোকানে এসে আড্ডা দেন। তার চেয়ে বয়সে ছোট অনেকের সাথেই তার গভীর সখ্যতা। যাদের কেউ কেউ জানেনও না কে এই মানুষটি। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় সবার আগে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। সেতো একটা সোনার বাংলাদেশ চেয়েছিলাম বলে। কারো স্বার্থসিদ্ধি করতে যুদ্ধ করিনি। এই বরিশালে  কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে না, তা আমার চেয়ে ভালো আর কে বলতে পারে? কিন্তু তরুণ প্রজন্মের সেই ঘটনা জানার কোনো আগ্রহ নেই বলে হতাশা প্রকাশ করেন মহিউদ্দিন মানিক। বলেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমা-ার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে অনেকের অনৈতিক অনুরোধ রক্ষা করতে না পারায় কেউ কেউ আর আমাকে পছন্দ করেন না। একা থাকি বলেও একটা দুর্নাম আছে। আমি চাইলেই বিদেশে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ের কাছে চলে যেতে পারি। কিন্তু এই বরিশাল, এই কীর্তনখোলার নদী জল হাওয়া ছেড়ে কোথাও যেয়ে শান্তি পাইনা। আমৃত্যু এই বরিশালেই কাটাতে চাই।
বরিশালের বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং  তরুণ প্রজন্মের কাছে চরম অবহেলিত বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধার নাম উঠে আসে অবলীলায়। দলীয়করণ প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখার ফল এটি বলে মনে করেন মহিউদ্দিন মানিক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্যে থেকে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনকে তাদের অবদানের ভিত্তিতে বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক উপাধিতে ভূষিত করেন। বীর প্রতীক চতুর্থ সর্বোচ্চ উপাধি। লাখ লাখ মুক্তিযোদ্ধার মধ্য থেকে মোট ৪২৬ জনকে এই উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। বরিশালের কেএসএ মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতীক তাদের একজন। তার নাম গ্রন্থিত রয়েছে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্র ও গ্রন্থে। এমনকি ১৫ই আগস্টের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর বেঁচে যাওয়া সেরনিয়াবাত পরিবারের সদস্যদের মুখেও ছিলো মানিকের নাম। প্রয়াত আমেনা বেগম, বিউটি সেরনিয়াবাত এবং শাহানারা আব্দুল্লাহ তাদের দেয়া সাক্ষাৎকারে মানিককে ধন্যবাদ জানিয়েছেন অবরুদ্ধ সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা এবং বন্ধু-বান্ধব, স্বজনহীন পরিস্থিতিতে পাশে থাকার দুঃসাহস দেখানোর জন্য। যার প্রমাণ পাওয়া যায় মাসিক আনন্দলিখন পত্রিকার আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সংখ্যায়।
কেএসএ মহিউদ্দিন মানিক এর বাবা কাজী মনোয়ার হোসেনও ছিলেন একজন যোদ্ধা। তিনি একাধারে কবি, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। এমনকি বরিশালের ইতিহাস রচয়িতাদের একজন তিনি। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ছিলেন কাজী মনোয়ার হোসেন। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যুদ্ধ শুরু হলে তিনি নেতাজী সুভাষ বসু আজাদ-হিন্দ ফৌজে যোগ দেন এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেন। তারই বড় ছেলে মহিউদ্দিন মানিক ছোটবেলা থেকেই ছিলেন দুর্দান্ত সাহসী। ওই বয়সেই তিনি রাইফেলস ক্লাবের শ্যূটার সদস্য ছিলেন এবং রাইফেল ও পিস্তল চালানোয় পারদর্শী ছিলেন। তার মা আনোয়ারা বেগম সুশিক্ষিত আদর্শ গৃহিণী ছিলেন। মহিউদ্দিন মানিকের সহধর্মিণী কামরুন্নাহার নাজনীন। তাঁদের এক মেয়ে মেয়ে খ্যাতনামা চিত্র শিল্পী কাজী নার্গিস আফরোজা তানিয়া এবং এক ছেলে আন্তর্জাতিক স্যুটিং ফেডারেশনের সাথে জড়িত কাজী মাহতাবউদ্দিন তৌফিক।
১৯৭১ সালে মা-বাবার সম্মতি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তিনি। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানায় পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। এ সংবাদ পেয়েই ২৬ মার্চ বরিশাল পুলিশ লাইনস থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়ে মানিক ও আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম মঞ্জুরসহ কয়েকজন প্রথমে লাকুটিয়া জমিদার বাড়িতে ও পরে রহমতপুরের একটি ঘাটিতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখেন। তৎকালীন রাইফেলস ক্লাবের সদস্য হবার কারণে মানিকের পক্ষে গোলাবারুদ ও অস্ত্রাগার সম্পর্কে জানা সহজ ছিলো। ফলে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ নিয়ে যাওয়া সহজ হয় তাদের জন্য।
মানিক জানান, লাকুটিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটা ঘাঁটি ছিলো। প্রয়াত হালিম চেয়ারম্যান সেটির নেতৃত্বে ছিলেন। বাবুগঞ্জের নেতৃত্বে ছিলেন প্রয়াত ওহাব খান। ২৫ এপ্রিল ওই অস্ত্র নিয়ে আমরা বানারীপাড়ায় চলে যাই। সেখানে কয়েকজন মিলে মুক্তিবাহিনীর একটি দল গঠন করেন মানিক। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তারা সাব-সেক্টর কমান্ডার শাহজাহান ওমরের দলে যোগ দেন। এরপর থেকে সবসময় শাহজাহান ওমর এর সঙ্গেই যুদ্ধ করেন মানিক।
মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতে চাইলেই মানিকের চোখেমুখে যুদ্ধকালীন সময়ের অনুভূতি নেচে ওঠে। কথা বলার ব্যকুলতায় পেয়ে বসে তাকে। তিনি একদিনের ঘটনা তুলে ধরে বলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটিতে কয়েক দিন আক্রমণ ও সফল অভিযান চালিয়ে আমরা মুক্তিযোদ্ধারা বেশ ক্লান্ত। একদিন রাতে সবাই একটি খালের ভিতর ভাসমান নৌকায় অবস্থান করছি। ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত থাকায় কয়েকজন ছাড়া সবাই নৌকায় ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাদের নেতৃত্বে ছিলেন শাহজাহান ওমর। ভোরে দু’জন লোক সেখানে এসে আমাদের জানায়, তাদের গ্রামে একদল পাকিস্তানী সেনা অবস্থান করছে।
নৌকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধারা কোনো চিন্তা না করেই ওই গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। গ্রামে ঢুকে বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন জ্বলতেও দেখেন তাঁরা। কী করবেন ভেবে উঠতে পারছেন না। ভোরের আলো তখনো পুরোপুরি ফোটেনি। হঠাৎ মানিক দেখতে পান কয়েকজন পাকিস্তানী সেনাকে। তারা জঙ্গলের ভেতর শুয়ে আছে, তাদের মাথার হেলমেট চিকচিক করছে।
মানিক বলেন, ওদের দেখে প্রথমে আমার সহযোদ্ধা জিয়াউদ্দিনকে এ কথা বলি। তিনি প্রথমে তা বিশ্বাস করেননি। এরপরই খালের ওপর সাঁকোর পাশে পাকিস্তানী সেনাদের দেখা গেল। খালের দুই পাড়ে চারটি স্থানে তাদের মর্টারের অবস্থান। আমি সঙ্গে সঙ্গে সহযোদ্ধা জিয়াউদ্দিনের কাছে থাকা মর্টারে গোলা ভরে দিলাম। তিনি মর্টার চার্জ করলে তা পাকিস্তানি সেনাদের মর্টারের অবস্থানে গিয়ে পড়ে। এরপর শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ।
সংবাদ পেয়ে আশপাশে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যান্য দলও আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। আমরা পাকিস্তানি সেনাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলি। সারাদিন যুদ্ধ চলে। অসংখ্য পাকসেনা সেদিন নিহত হয় ও ধরা পড়ে। অধিকাংশই পাকসেনা স্থানীয় জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। গ্রামের মহিলারাও দা দিয়ে কুপিয়ে তাদের হত্যা করে। সেদিনের যুদ্ধে আমার কপালের ডান দিকে গুলি লাগে। আমি আহত হই। আমার সহযোদ্ধা আউয়াল শহীদ হন। ঘটনাটি ঘটে ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার চাচৈর গ্রামে।
৮ ডিসেম্বর তাদের দলটি বাকেরগঞ্জ থানা মুক্ত করে। সেদিন শাহজাহান ওমর বীরউত্তম এর সাথে সাথে তিনিও আবার গুলিবিদ্ধ হন।
মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠলেই এরকম অসংখ্য ঘটনা নিয়ে আবেগাপ্লুত মহিউদ্দিন মানিক বীরপ্রতীক। জিপসি মোটরসাইকেলে ৭৩ বছর বয়সেও যিনি টগবগে যুবক যেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিলো ২০ বছর। ২১ নভেম্বর ১৯৫০ সালে বরিশালের গোড়াচাঁদ দাস রোডে জন্মগ্রহণ করেন মহিউদ্দিন মানিক। এরপর বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে নয় নম্বর সাবসেক্টর হেড কোয়ার্টারের কমান্ডার মেজর শাহজাহান ওমর বীরউত্তম-এর একান্ত সহকারী হিসাবে যোগ দেন এবং সরাসরি তার কমান্ডে বরিশাল অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে কয়েকবারই আহত হন এবং দেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭২ সালের জানুয়ারীর শেষ ভাগ পর্যন্ত অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শেষে অস্ত্র জমা দিয়ে ছাত্র রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তারপর থেকে পড়াশুনা, সামাজিক, মানবিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে ড়েন তিনি।  ৭৩ বছর বয়সে ডাক পেলেই সাংস্কৃতিক সব কর্মকা-ে থাকার চেষ্টা করেন বীরপ্রতীক মহিউদ্দিন মানিক। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের বরিশাল বিভাগের দায়িত্ব পালন ছাড়াও জেলা দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তিনি। তিনিই প্রথম বীর মুক্তিযোদ্ধা যার হাত দিয়ে পাকিস্তানের মাটিতে বাংলাদেশের পতাকা উড়েছে। ২০০০ সালের সাব-গেমস উদ্বোধন পর্বে তিনি পাকিস্তানের করাচি নেভি গ্রাউন্ডে বাংলাদেশের পতাকা বহন করে বিরল সম্মান অর্জন করেন।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT