4:09 pm , August 25, 2023
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বিভাগীয় শহর বরিশালের সৌন্দর্যের প্রধান আকর্ষণ কীর্তনখোলা নদী ও নদী তীরবর্তী পাঁচ কিলোমিটার এলাকা। অথচ নদী তীরবর্তী এই এলাকার নামার চর, বরফ কল ও ভাটার খাল পুরোটাই এখন দখল করে নিয়েছে অবৈধ স্থাপনা, দোকানপাট, হাঁস-মুরগি, ছাগলসহ বিভিন্ন বাড়িঘর। প্রভাবশালী একটি মহলের ছত্রছায়ায় পুরো এলাকা জুড়ে মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। অথচ মাস ছয়েক আগেও বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেছিলেন, সিটি করপোরেশনের সাথে সমন্বয় করে আমাদের উচ্ছেদ অভিযান খুব শীঘ্রই পুনরায় শুরু হবে। তার আগে সবাইকে নোটিশ দেয়ার কাজ চলছে। তাদের নোটিশ দেয়ার অবসরে বরিশালে গড়িয়েছে অনেক নদীর জল। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নতুন মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণের অপেক্ষা এখন। এই অবসরে নদী তীরবর্তী এলাকায় পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ইজারা হয়েছে। স্পীডবোট ঘাটের দখলদারি বদলেছে। কিন্তু পাইকারী কাঁচাবাজারের সামনের কাটা তারের বেড়াটি আজো যথাস্থানেই রয়েছে। এগুলো দেখার জন্য যথেষ্ট সময় থাকলেও অবৈধ স্থাপনা ও নদী তীরবর্তী এলাকার দূষণমুক্ত করার কোনো উদ্যোগই প্রশাসন নেয়নি বলে অভিযোগ কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দের। তারা জানান, বাজারের সামনে কাঁটা তারের বেড়া দেয়ার কারণে এখন আর মাল বোঝাই নৌকা এখানে ভিড়তে পারেনা। ফলে মালামাল আনা নেওয়া করতে কষ্ট ও খরচ দুটোই বেড়েছে বলে জানান কাঁচামাল ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ আলম।
অন্যদিকে কীর্তনখোলা নদীর লঞ্চঘাট থেকে দক্ষিণে কেডিসি হয়ে ত্রিশ গোডাউন পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটারের বেশি এলাকার ওয়াকওয়ে দখল করে গড়ে উঠেছে দোকানপাট ও পশুদের থাকার ঘর। নগরীর ১০, ১১, ১২ নং ও ২৪ নং ওয়ার্ডভুক্ত এলাকা চাঁদমারী খেয়াঘাট থেকে ত্রিশ গোডাউন হয়ে গ্যাসটারবাইন পর্যন্ত। এই সীমানা জুড়ে প্রায় ৮/১০ হাজার বস্তিঘর তৈরি হয়েছে এবং এগুলোকে ঘিরে মাদকের বেচাকেনা ক্রমশ বাড়ছে বলে দাবী ১০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শহীদুল্লাহ কবীরের। ১০ নং ওয়ার্ড নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী সবুজ বলেন, সন্ধ্যার পর এই ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটাচলা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। বাতাসে শুধু গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকের গন্ধ পাবেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, এখানে আওয়ামী লীগ নেতা শেখর দাসের রাজত্ব চলে। তার সাথে অভিযোগের আঙুল নৌ পুলিশ ও মেরিন বিভাগের কর্মকর্তাদের দিকেও। তাদের প্রশ্রয়েই এখানে অবৈধ ঘরবাড়ি দোকানপাট গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
সরেজমিনে ২৫ আগস্ট শুক্রবার নগরীর ডিসিঘাটের ভাঙা ও ঝুকিপূর্ণ কাঠের পুলটি পার হতেই ভ্রমনে আসা দুইজন অতিথির কটাক্ষ শুনতে হলো শহর রক্ষা বাঁধের উপর অনেকগুলো হাঁস-মুরগি ও ছাগলের খোঁয়াড় নিয়ে। তারা সেগুলোর ছবি তুলছেন আর বলছেন এ কী? এগুলো প্রশাসন কি দেখেনা?
এখানে অনেকটা অংশে বাঁধে ভাঙন ধরেছে। একটু এগিয়ে চোখে পড়ে নদীরক্ষা বাঁধের পায়েচলা পথে এখন গড়ে উঠেছে অসংখ্য অবৈধ ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও হাস মুরগী এবং ছাগলের ঘর। নদীর মধ্যে খুঁটি গেড়ে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দোকান, রান্নাঘর, এমনকি গোয়ালঘরসহ আরো অনেক কিছুই দেখা গেল মুক্তিযোদ্ধা পার্ক পার হয়ে ১০ নং ওয়ার্ড সীমানার নদী তীরবর্তী এলাকায়। শুধু তাই নয় নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড, মেরিন বিভাগের কয়েকটি জেটি ছাড়াও নদী ফায়ার স্টেশনও তৈরি হয়েছে নদী দখল করেই। আর এ সুযোগ নিয়েই জেটির পিলার বরাবর নদী দখল করে নিচ্ছে একটি মহল। আর এসব কারণে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে বাঁধের কয়েকটি স্থানে। প্রশাসনের নৌবহর বা জেটি বিষয়টি জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এটিকে এড়িয়ে গিয়ে দোকানপাট ও পায়েচলা পথ আটকে দেয়া নিয়ে প্রশ্ন করলে স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা তেড়ে আসেন ও বলেন, যা বলার স্থানীয় কাউন্সিলরকে বলুন। এ পাশটা ১০ নং ওয়ার্ড আর মুক্তিযোদ্ধা পার্কের উত্তর পাশটা আওয়ামী লীগ নেতা শেখর দাসের নিয়ন্ত্রণে বলে জানান তারা। সব মিলিয়ে কীর্তনখোলা নদী তীরবর্তী এই এলাকায় উত্তরাংশে দোকানপাটসহ প্রায় তিন হাজার ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ শেখর দাসের এবং মুক্তিযোদ্ধা পার্কের দক্ষিণে কেডিসি হয়ে ত্রিশ গোডাউন পর্যন্ত ১০ নং ওয়ার্ডের নদী তীরবর্তী সীমানায় প্রায় পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি ও দোকানপাট রয়েছে। তবে কাউন্সিলর শহীদুল্লাহ্ কবীর স্পষ্ট জানালেন, কোনো ভোট ব্যাংক বা এসবের মধ্যে নেই তিনি। তিনি বলেন, এগুলো মিথ্যা কথা। অবৈধ ঘরবাড়ি দোকানপাট দেখে আমিও বিরক্ত। জনপ্রতিনিধি হবার কারণে আমিতো উচ্ছেদ করতে পারিনা তাই নিজেই কয়েকবার বিআইডব্লিউটিএর কাছে এ নিয়ে অভিযোগ করেছি। আর শেখর দাসের বিষয়ে আমি কিছুই জানিনা। তারটা তিনিই বলবেন।
অন্যদিকে শেখর দাস কে পাওয়া না গেলেও স্প্রীডবোট ঘাটে তার অনুসারীদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানালেন, নদী তীরবর্তী এই এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিআইডব্লিউটিএর। নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড, মেরিন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিস যৌথভাবে এই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। এদিকের বেশিরভাগ এলাকা সিটি করপোরেশন ও বিআইডব্লিউটিএর আওতায় বলে এবিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজী হয়নি জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ মুহূর্তে কথা বলে লাভ নেই আগামী অক্টোবরের পর কথা বলুন, সব কিছু তখন জানতে পারবেন বলে জানালেন জনসংযোগ কর্মকর্তা স্বপন কুমার দাস। আর বিআইডব্লিউটিএ বরিশালের কেউ ফোনই ধরেন না।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম বলেন, সরকার শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করে। সেখানে যদি জনগণ দোকান পাট নির্মাণ করে বা সঠিকভাবে ব্যবহার না করে তাহলে এই বাঁধ বেশীদিন টেকসই হবে না।এই বিষয়টা সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, কীর্তনখোলা রক্ষা বাঁধ নিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এজন্য বরিশালবাসীকে আরেকটু ধৈর্য্য ধরতে হবে । এখানে নদী তীরবর্তী ৫ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। খুব শীঘ্রই খেয়াঘাট থেকে দপদপিয়া ফেরীঘাট পর্যন্ত এই ওয়াকওয়ে বরিশালের সৌন্দর্য শতগুণ বাড়িয়ে দেবে। আশেপাশের স্থাপনা সরিয়ে নিতে নোটিশ দেয়াসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাও হয়েছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।