4:12 pm , August 23, 2023
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ মাঝারী থেকে ভারী বর্ষণে এককালের ‘প্রাচ্যের ভেনিস’ খ্যাত বরিশাল মহানগরী ডুবলেও নগর ভবনের তেমন কোন মাথাব্যথা নেই। ফলে বার বারই মানবিক বিপর্যয়ের কবলে পড়ছে নগরবাসী। শুধু বৃষ্টিপাতই নয় গত কয়েক বছর ধরে নগরীর পাশে প্রবাহমান কীর্তনখোলার জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেলেও নগরীর ড্রেনের পানি রাস্তায় গড়াচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে বরিশাল মহানগরী পানির তলায় চলে গেলেও তা থেকে নগরবাসীকে পরিত্রান দিতে তেমন কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি এসব বিপর্যয়ের পরেও নগরীর ড্রেনগুলো পরিস্কার করার তেমন কোন নিবিড় কার্যক্রম চোখে পড়েনি। গত বছর আগষ্টে ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ এ ভর করে প্রবল বর্ষন ও কীতনখোলা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় পুরো নগরী ডুবে গিয়েছিল। এমনকি বৃষ্টি বন্ধ ও নদীর পানি বিপদসীমার নিচে নেমে যাবার এক সপ্তাহ পরেও নগরীর অনেক এলাকা পানির তলায় ছিলো। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সূত্রের
মতে, ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’এ ভর করে গত বছর ২৫ আগষ্ট সকাল ৯টার পূর্ববর্তী ২৪ ঘন্টায় বরিশাল মহানগরীতে ২৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের সময় পাশর্^বর্তী কীর্তনখোলা নদীর পানি বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপরে প্রবাহিত হচ্ছিল। অথচ গত ৭ আগষ্ট সকাল ৯টার পরবর্তী ২৪ ঘন্টায় বরিশালে ১৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের সময় ভরা জোয়ারেও কীর্তনখোলার পানি বিপদসীমার ২৮ মেন্টিমিটার নিচে প্রবাহিত হলেও গোটা মহানগরীর জলাবদ্ধতা ছিল আগের পর্যায়েই। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পরিস্থিতি বরিশাল মহানগরীর পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থার অধপতনকেই নির্দেশ করছে। যা আগামীতে নগরীর জন্য চরম দুর্যোগ সহ ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের বার্তা দিচ্ছে। নগরবাসীর অভিযোগ, নগর ভবনের অনেক দায়িত্বশীলরা নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি ভুলে যাচ্ছেন। অনেকে নগরবাসীর প্রতি নগর পরিষদের প্রতিশ্রুতি ও দায়বদ্ধতাকেও মনে রাখেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। নগরীর ড্রেনসমূহ নিয়মিত পরিষ্কার না করার অভিযোগ এখন রীতিমত পুরনো হয়ে গেছে। গত ৭ আগষ্ট সন্ধ্যা ৬টার পূর্ববর্তী ৩৬ ঘন্টায় ২২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে ৫৮ বর্গ কিলোমিটারের বরিশাল মহানগরীর পুরোটাই পানির তলায় চলে যায়। ফলে ৫ লক্ষাধিক নগরবাসীর শুধু দুর্ভোগই নয়, অনেক এলাকায় চরম মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। এসময় কীর্তনখোলার পানি বিপদসীমার নিচে প্রবাহিত হচ্ছিল। মঙ্গলবার সকাল থেকে বরিশাল অঞ্চলে আবহাওয়া পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে। টানা এক সপ্তাহ পরে বুধবার সকাল ৯টা ৭ মিনিটে বরিশাল মহানগরীতে সূর্যের হাসি ছড়ালেও নগরীর অনেক রাস্তাঘাট সহ বিশাল জনপদ তখনো পানির তলায়।
বরিশাল মহানগরীর কাঁচা পাকা প্রায় দেড়শ কিলোমিটার ড্রেন নিয়মিত পরিস্কার না করার অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। বিষয়টি নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে নগরবাসী যেমন খুব বেশী আওয়াজ করতে পারেননি, তেমনি তাদের দীর্ঘশ^াস নগর ভবনের সীমানায়ও পৌঁছেনি। নগরীর ভঙ্গুর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা সহ বরিশাল নদী বন্দরের নাব্যতা রক্ষার নামে গত প্রায় দুই দশক ধরে ড্রেজিংকৃত পলি নদীতেই অপসারন করায় কীর্তনখোলায় সংযুক্ত খালগুলোর মোহনা ভরাট হয়ে গেছে। ফলে এ নগরীর ভঙ্গুর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা আরো রুদ্ধ হলে তা নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই।
নগরীর ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করার অভিযোগ এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। এমনকি এ মাসের শুরু থেকে দফায় দফায় মাঝারী থেকে প্রবল বর্ষনে পুরো নগরী পানির তলায় চলে গেলেও দুর্যোগের পরেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক ড্রেনই পরিষ্কার করার কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। অথচ চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসের মধ্যে ৬ মাসেই বরিশালে বৃষ্টিপাতের পরিমান ছিল স্বাভাবিকের কম। এমনকি গত জুলাই মাসেও বরিশালে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৮% কম বৃষ্টি হলেও নগরীর নবগ্রাম রোডের বটতলা থেকে করিম কুটির পর্যন্ত প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকার ড্রেনের পানি রাস্তা ছুঁই ছুঁই করছিল। কোন মাঝারী বর্ষন বা ভারী বৃষ্টিপাত ছাড়াই অনেক সময় ড্রেনের পানি রাস্তায় গড়াতেও দেখা যায় বছরজুড়ে। জুলাই মাসে বরিশালে ৫৮% বৃষ্টিপাতের ঘাটতির পরে ১ আগষ্ট সকাল থেকে ৭ আগষ্ট রাত পর্যন্ত প্রায় ৫শ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে নবগ্রাম রোড সহ পুরো নগরীজুড়ে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। গত কয়েক বছর ধরে নগর ভবনের উদাসীন দায়িত্বশীলরা নগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন দূরে থাক, যথাযথ সংরক্ষনেও বিবেকহীন নিরবতা পালন করেছেন। ফলে এর দুর্ভোগ বহন করতে হচ্ছে ৫ লক্ষাধিক নগরবাসীকে। এদিকে বরিশাল মহানগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নে গত কয়েক বছরে নগরভবন থেকে কোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। আগের নগর পরিষদ নগরীর কিছু খাল খনন ও পুনরুদ্ধারের প্রায় সোয়া ২শ কোটি টাকার একটি ‘উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা-ডিপিপি’ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে দৌঁড়ঝাপ করলেও তা অনুমোদন লাভ করেনি। বর্তমান নগর পরিষদ দায়িত্ব গ্রহন করে ওসব খাল খননে প্রায় সাড়ে ১১শ কোটি টাকার ডিপিপি দাখিল করলেও মন্ত্রণালয় থেকে পরামর্শকের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সহ প্রকল্প ব্যয় কমিয়ে তা পুণর্গঠনের দিক নির্দেশনা দিয়ে তা ফেরত পাঠায়।
পরবর্তী পরামর্শকের সমীক্ষা সহ প্রায় ২২শ কেটি টাকার ডিপিপি দাখিল করা হলে মন্ত্রণালয় তা পরিকল্পনা কমিশনে না পাঠিয়ে ফেরত দিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ‘এ সংক্রান্ত একটি ডিপিপি এখনো পরিকল্পনা কমিশনের বিবেচনাধীন’ বলে জানিয়েছেন। অপরদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ড মহানগরীর ৭টি খাল সংষ্কার ও উন্নয়নে ১০.৭৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করলেও নগর ভবন থেকে এ লক্ষে তাদের ‘দাখিলকৃত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়’ বলে জানিয়ে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কার্যক্রম বন্ধ রাখার অনুরোধ করে। পাউবো’র প্রকল্পটির আওতায় নগরীর পলাশপুর খাল, আমানতগঞ্জ খাল, জেল খাল, ভাটার খাল, চাঁদমারী খাল, সাগরদী খাল ও রুপাতলী খালের প্রায় ১৮ কিলোমিটার অংশ সংষ্কারের লক্ষ্যে দু দফায় দর প্রস্তাব গ্রহন করে মূল্যায়নও সম্পন্ন করেছে। প্রকল্পের আওতায় এসব খালের দুই ধারে ওয়াকওয়ে নির্মান সহ কিছু অবকাঠামো নির্মান করবে বলেও জানা গেছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পটিতেও নগরীর পশ্চিম অংশের পয়ঃনিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম নবগ্রাম রোড খালটি সংস্কার ও উন্নয়নে অন্তর্র্ভূক্ত করা হয়নি। ফলে নগরীর পশ্চিম অংশের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন এখনো সুদূর পরাহত।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৭ খাল খনন ও সংস্কার প্রকল্প সম্পর্কে পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক জানান, খুব শীঘ্রই আমরা কার্যাদেশ প্রদান করবো। আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্পটির মূল কাজ সম্পন্ন করার কথাও জনান তিনি। ফলে আগামী বর্ষা মৌসুমে বরিশাল মহানগরীর ‘ভয়াবহ জলাবদ্ধতার অনেকটাই নিরসন হবে’ বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।