3:51 pm , August 22, 2023
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ খাদ্য উদ্বৃত্ত বরিশাল অঞ্চল দুধ, ডিম ও গোসতের সাথে মাছের উৎপাদনও এখন চাহিদার প্রায় দ্বিগুনের কাছে। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস ও অতি বর্ষনের মত প্রাকৃতিক দূর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করেই বরিশাল অঞ্চলের মৎস্যজীবীরা ‘মাছে ভাতে বাঙালী’র বাস্তব উদাহরন সৃষ্টি করলেও মাঠ পর্যায়ে কারিগরি সহায়তা সহ নানা সীমাবদ্ধতায় এ খাতের কাঙ্খিত উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। তবে নানা সীমাবদ্ধতা সত্বেও গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে মাছের উৎপাদন প্রায় ৭৫% বৃদ্ধি পেয়ে ৩ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে এখন প্রায় ২.৩৫ লাখ টন উদ্বৃত্ত এলাকা। এমনকি গত এক দশকে দেশে মাছের উৎপাদন ৫৩% বাড়লেও প্রায় ১১ লাখ টন খাদ্য উদ্বৃত্ত দক্ষিণাঞ্চলে মৎস্যখাতে প্রবৃদ্ধির হার ৭৫%। মৎস্য অধিদপ্তরের মতে, গত এক দশকে দক্ষিণাঞ্চলে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ১১২%। আর সারা দেশে ইলিশের ৬৬%-ই আহরিত হয় দক্ষিণাঞ্চলে। আন্তর্জাতিক পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে একজন মানুষের দৈনন্দিন ৬০ গ্রাম মাছের চাহিদার বিপরীতে আমাদের দেশে তা ইতোমধ্যে ৬২.৫৮ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৮’এর হিসেব অনুযায়ী, দেশের মোট জিডিপি’র ৩.৫৭% এবং কৃষিজ জিডিপি’র ২৫.৩০% মৎস্যখাতের অবদান। দক্ষিণাঞ্চলে এ হার আরো বেশী বলে মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। অধিদপ্তরের মতে, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ১১ শতাংশরও বেশী মানুষ মৎস্য সেক্টর থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। ২০১৬-১৭ সালে দেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও আরো ৫ বছর আগেই দক্ষিণাঞ্চল এখাতে স্বয়ংসম্পূর্নতা অর্জন করেছে।
জাতিসংঘের ‘খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-ফাও’এর ২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী মুক্ত ও অভ্যন্তরীণ জলাশয়ে মাছ আহরনে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে তৃতীয় স্থানে এবং বদ্ধ জলাশয়ের মৎস্য উৎপাদনে ৫ম স্থানে রয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলও এক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। এ অঞ্চলের ৬টি জেলার প্রায় ২৬ হাজার হেক্টর বদ্ধ জলাশয়, ৪ লাখ ২৭ হাজার ৪৮২ হেক্টর উন্মুক্ত জলাশয় ছাড়াও প্রায় আড়াই হাজার বেসরকারী মৎস্য খামার, ৫০টির মত সরকারী-বেসরকারী মৎস্য হ্যাচারী, ৯২০টি নার্সারী খামার ছাড়াও প্রায় ৯ হাজার চিংড়ি খামার মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক অবদান রাখছে। মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষি ফসলের চেয়ে মাছে মুনাফা বেশী হওয়ায় বরিশাল অঞ্চলের মানুষ মাছ চাষে ঝুকছে। তবে ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর’এর পরে মহাসেন, আম্পান, আয়লা ও সিত্রাং-এর মত ঘূর্ণিঝড় সহ প্রবল বর্ষণে বরিশাল অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মাছের ঘের, পুকুর ও দিঘী প্লাবিত হয়ে কোটি কোটি মাছ ও পোনা ভেসে গিয়ে চাষীরা সর্বশান্ত হলেও তারা দমে থাকেন নি। বরিশাল অঞ্চলের ৪২টি উপজেলাতেই মাছ চাষে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যে এ অঞ্চলের ১১টি নদ-নদীকে অভয়াশ্রম ঘোষনা করা হয়েছে। যা উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়ক ভুমিকা পালন করছে বলে জানা গেছে। তবে অব্যাহত নগরায়নের ফলে মহানগরী সহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলা শহরগুলোর পুকুর, দীঘি ও খালগুলো ক্রমাগত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যা মৎস্য সেক্টরের জন্য একটি হুমকি বলেই মনে করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞগন। এরপরেও বরিশাল অঞ্চলে প্রায় ৪ লাখ ২৭ হাজার পুুকুর ও দীঘি, ৬৬৭টি বরোপীট, ৯০টি প্রবাহমান নদ-নদী, ৪৩টি বিল, একটি বাঁওড় বা মরা নদী, প্রায় দেড় হাজার খাল ও সোয়া ৬শ প্লাবন ভূমি সহ মোট ৫৪ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টরে কম বেশী মাছ উৎপাদন হচ্ছে। এসব জলাশয়ে মাছের উৎপাদন ২০০৮-০৯ সালে ২ লাখ ৯৮ হাজার টন থেকে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৫ লাখ ২৩ হাজার টন ও ’২১-২২ অর্থ বছরে তা প্রায় ৫ লাখ ৩২ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। যার মধ্যে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার টনের মত। ২১-২২ অর্থ বছরে দেশে ইলিশের সহনীয় আহরন ছিল ৫.৬৬ লাখ টন।
এছাড়াও প্রায় ৬০ হাজার টন রুই জাতীয় মাছ এবং পাঙ্গাস, শিং-মাগুর, কৈ, তেলাপিয়া এবং চিংড়ি ছাড়াও অন্যান্য মাছের উৎপাদনও ছিল দেড় লাখ টনের মত। এ সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের সরকারী-বেসরকারী ৫০টি হ্যাচারী ও ৯২৩টি নার্সারীতে প্রায় ১৮ হাজার কেজি রেনু ও ২৫ লাখ ১৮ হাজার মাছের পোনা উৎপাদন হয়েছে।
বরিশাল অঞ্চলের প্রায় ৫ লাখ জেলে মৎস্য সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল। যারমধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৩ লাখ ২ হাজার ৪৭৪। অধিদপ্তরের মতে, এ অঞ্চলে জেলে পরিবারের সংখ্যা আড়াই লাখের মত। মৎস্য অধিদপ্তরের অপর এক পরিসংখ্যানে দেশের ৮টি বিভাগের মধ্যে শুধুমাত্র বরিশাল বিভাগেই প্রায় সাড়ে ৩ লাখ জেলে ইলিশ আহরনে জড়িত। যার ৬৫% সার্বক্ষণিক ও ৩৫% খন্ডকালীন বলে জানা গেছে। বিগত ২২-২৩ অর্থ বছরে বরিশাল অঞ্চলের প্রায় ২ হাজার জলাশয়ে রাজস্ব ও উন্নয়ন খাতে ৫৩ লাখ বিভিন্ন মাছের পোনা অবমুক্ত করেছে মৎস্য অধিদপ্তর।
সরকার ২০১২-১৩ অর্থ বছরকে ভিত্তি হিসেবে ৭ম পঞ্চ বার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের মৎস্য চাষি ও মৎস্যজীবীদের আয় ২০% বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারন করেছে। এ লক্ষ্যে দক্ষিণাঞ্চলেও বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প ও কর্মসূচী গ্রহনের কথা জানান হয়েছে। দেশের বিভিন্ন উন্মূক্ত জলাশয়ে খাচায় মাছ চাষ কার্যক্রম অতীতে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও অতি সম্প্রতি তা কিছুটা স্থিমিত হয়ে পড়েছে। বরিশাল অঞ্চলে বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার খাঁচায় ১২ শ মৎস্যজীবী মাছ চাষ করে বছরে প্রায় এক হাজার টন বিভিন্ন ধরনের মাছ উৎপাদন করছেন।
পাশাপাশি এ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় কাকড়া ও কুচিয়া চাষ যথেষ্ট সম্প্রসারন ঘটছে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে এ অঞ্চলের ৩ হাজার টন কুচিয়া ও সাড়ে ৭শ খামারে ৩শ টন কাকড়া উৎপাদন হয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর। ৬টি জেলার ১১টি উপজেলায় পুকুরে কিশোর কাকড়া চাষ, পেনে কাকড়া মোটাতাজা করন, খাঁচায় কাকড়া মোটাতাজা করন ও সামাজিক পর্যায়ে কুচিয়া চাষ-এর ২৫টি প্রদর্শনী খামার স্থাপন করা হয়েছে।
গত অর্থ বছরে দক্ষিণাঞ্চলের ৮টি উপজেলার প্রায় ৩ হাজার মৎসজীবী দেড় হাজার টন শুটকী উৎপাদন করেছে। যার পুরোটাই ছিল রোদে শুকানোর মত লাগসই প্রযুক্তির এবং কীটনাশক মুক্ত বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।
তবে জনবল সংকটে বরিশাল বিভাগে মৎস্য অধিদপ্তরের কার্যক্রম অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম। এ অঞ্চলের ৬টি জেলার ৪২টি উপজেলার জন্য মাত্র ১৭০ কর্মকর্তার মঞ্জুরীকৃত জনবলের ১০১টি পদই শূণ্য। পাশাপাশি ২শ কর্মচারীর অনুমোদিত পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ১২০ জন। এ অঞ্চলে সিনিয়র সহকারী পরিচালকের ৭টি পদের বিপরীতে আছেন মাত্র ১ জন। চার জন সহকারী পরিচালকের পদের বিপরীতে কর্মরত ২ জন। অনুরূপভাবে প্রতিটি জেলা ও উপজেলাতেই বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ শূণ্য থাকায় বরিশাল অঞ্চল জুড়েই মৎস্য চাষ ও উৎপাদন সহ সার্বিক কার্যক্রমই বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
এসব বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় উপ-পরিচালক এর সাথে আলাপ করা হলে তিনি বলেন, নদ-নদী বহুল দক্ষিণাঞ্চলে মাছ চাষের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি উন্নত প্রযুক্তিতে মাছচাষ সম্প্রসারনে। এ লক্ষ্যে মাছ চাষে সাধারন মানুষকে আগ্রহী করে তোলা সহ সব মৎস্যচাষীকে উন্নত প্রযুক্তিতে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। অধিদপ্তরে জনবল সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি সদর দপ্তর ও মন্ত্রনালয়কে নিয়মিত অবহিত করা হচ্ছে। অদুর ভবিষ্যতে এ সংকট কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।