4:06 pm , August 12, 2023
বিশেষ প্রতিবেদক ॥ রাষ্ট্রীয় নৌ-বানিজ্য প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিসি’র ব্যর্থতার পরে এবার বেসরকারী একটি বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে নৌপথে প্রমোদ ভ্রমনের বিলাসবহুল নৌযান চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। ‘মেসার্স কার্নিভাল ক্রজ লাইন্স’ তাদের তিনতলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল ‘এমভি রাজারহাট-সি’ নামের নৌযানের মাধ্যমে আগামী অক্টোবরে ঢাকা থেকে বরিশাল-মোংলা হয়ে কোলকাতার হাওড়াতে একটি পরিক্ষামূলক নৌ পরিসেবা চালু করার প্রস্তাব দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ’র কাছে। কোম্পানীটির দায়িত্বশীল সূত্রের মতে, প্রথম ট্রিপের সব কিছু বিবেচনা করে নিয়মিত বানিজ্যিক ট্রিপের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়রম্যান কমোডর আরিফ আহমদ মোস্তফা বলেন ‘আমরা একটি প্রস্তাব পেয়েছি। বিষয়টির সবদিক বিবেচনা করা হচ্ছ। এলক্ষে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির রিপোর্ট পাবার পরে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ সহ তা আমরা নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে জানাবো। তবে আন্তঃদেশীয় এ নৌ পরিসেবার বিষয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে বলে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে বলা হয়েছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে করোনা পূর্বকালীন সময়ে বছরে প্রায় ২৩ লাখ যাত্রী চলাচল করত। যার বেশীরভাগই চিকিৎসা ও পর্যটনের জন্যই যাতায়াত করতেন। দু দেশের একাধিক স্থল বন্দর দিয়েই ৮০ ভাগেরও বেশী যাত্রী যাতায়াত করে থাকেন। এছাড়াও ঢাকা থেকে সপ্তাহে ৫দিন ও খুলনা থেকে দুদিন ট্রেন সার্ভিস চালু রয়েছে। পাশাপাশি প্রতিদিন গড়ে অন্তত ১০টি ফ্লাইট ঢাকা থেকে কোলকাতা, দিল্লী ও চেন্নাই রুটে চলাচল করছে। করোনা পরিস্থিতির কাঙ্খিত উন্নতির পরে দু দেশের মধ্যে যাত্রী চলাচল ক্রমশ বাড়ছে।
কিন্তু এসব যাত্রীদের একটি বড় অংশই চিকিৎসার জন্য কোলকাতা সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে যায় বিধায় তাদের জন্য নৌপথ অনেক সহনীয় ও আরামদায়ক ভ্রমণ হতে পারে। পাশাপাশি পর্যটনের উদ্দেশ্যে যাতায়াতকারীরাও নৌপথে ভ্রমণকালে সুন্দরবনসহ নদী মাত্রিক মাতৃভূমির আসল রুপ দেখত পাবেন। ভারত থেকে আসা পর্যটকরাও সুন্দরবন ও মোংলা বন্দর সহ বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখেতে পাবেন।
কিন্তু নৌপথে ভ্রমণে দুই দেশের মানুষের বিপুল আগ্রহ থাকলেও উভয় দেশের সরকারী কর্মকর্তাদের উদাসীনতা সহ যথাযথ উদ্যোগের অভাবে স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ এলক্ষে নৌ প্রটোকলও স্বাক্ষর হয়েছে ইতোপূর্বে। প্রটোকল অনুযায়ী ২০১৯ সালের মার্চে রাষ্ট্রীয় বিআইডিব্লউটিসি ‘এমভি মধুমতি’ নামের যাত্রিবাহী নৌযানের সাহায্যে ঢাকাÑকোলকাতা রুটে পরীক্ষামূলক পরিচালন সম্পন্ন করার পরে বানিজ্যিক যাত্রার আর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। সে যাত্রাটি মূলত নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় এবং বিআইডিব্লিউটিসি ও টিএ’র কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে সম্পন্ন হলেও প্রায় একশ যাত্রী ভ্রমণ করেছিলেন।
এদিকে ‘মেসার্স কার্নিভাল ক্রজ লাইন্স’এর পরিচালক ইমরান খান রাসেল জানান, তারা তাদের ২১০ ফুট দৈর্ঘ্যরে ‘এমভি রাজারহাট-সি’ নৌযানটির মাধ্যমে সম্ভাব্য ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে কোলকাতার উদ্যেশ্যে যাত্রা করতে চান। সে লক্ষেই বিআইডব্লিউটিএ’র কাছে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির অনেক যাত্রী ৫ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায় এ নৌযানে ভ্রমণে আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন বলেও জানান তিনি।
নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের অনুমোদিত নকশায় তৈরী ‘এমভি রাজারহাট সি’ নৌযানটিতে ১৪টি ভিআইপি কক্ষ ছাড়াও প্রথম শ্রেণি ১১০টি কক্ষে ২৪০ শয্যার যাত্রী সুবিধা রয়েছে। এছাড়া ডেক শ্রেণি সহ নৌযানটির যাত্রী বহন ক্ষমতা প্রায় ৭শ। কার্ণিভাল শিপিং লাইন্স-এর মতে ঢাকা থেকে তাদের নৌযানটি ছেড়ে ৩৬ ঘন্টার মধ্যে কোলকাতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। তবে সে ক্ষেত্রে নৌ পথে রাত্রীকালীন নৌ-সংকেত সুবিধা অন্যতম শর্ত। তারা নৌযানটিকে এমনভাবে পরিচালা করতে চান যাতে যাত্রীরা দিনের বেলা মোংলা বন্দর সহ সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। ঢাকা থেকে বরিশাল-মোংলা-কোলকাতা নৌপথটি মোংলা থেকে উত্তরে এগিয়ে চালনা হয় সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে আংটিহারায় পৌঁছে বাংলাদেশ অংশে কাষ্টম ও ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করবে। কিন্তু ভারতীয় অংশে এসব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের পরে কোলকাতা পর্যন্ত বিশাল নৌপথে নৌ-সংকেত না থাকায় এখনো রাত্রীকালীন নৌ যোগাযোগ সুবিধা নেই বলে জানা গেছে। সেক্ষেত্রে সময়সূচী নির্ধারনের ক্ষেত্রে অনেক কিছু বিবেচনায় নিতে হতে পারে বলেও জানা গেছে। উল্লেখ্য, প্রায় ৭০ বছর পরে দুই দেশের সরকার প্রধানের সিদ্ধান্তের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০১৯ সালের মার্চে আন্তঃদেশীয় নৌপথে যাত্রিবাহী নৌযান ‘এমভি মধুমতি’র সাহায্যে ঢাকা-কোলকাতা রুটে পরীক্ষামূলক পরিচালন এর আনুষ্ঠানিক সূচনা হলেও পরবর্তীতে আর কোন আগ্রগতি হয়নি। অথচ গত কয়েক বছরে কোলকাতা থেকে একাধিক যাত্রিবাহী নৌযানে বেশ কিছু পর্যটক বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। এমনকি গত ১১ জানুয়ারী উত্তর প্রদেশের বারানসী’তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৫১ দিনে ৩ হাজার ২শ কিলোমিটার নৌপথ ভ্রমণে ‘এমভি গঙ্গা বিলাস’ নামের একটি প্রমোদ তরীতে ভারত-বাংলাদেশ নৌ ভ্রমণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। গত ৪ ফেব্রুয়ারী নৌযানটি ভারত-বাংলাদেশের নৌ সীমান্তের আংটিহারা হয়ে মোংলাতে পৌঁছে। ‘এমভি গঙ্গা বিলাস’ ৮ ফেব্রুয়ারী বরিশালে পৌঁছে রাত্রীযাপনের পরে ঢাকায় যাত্রা করে পরবর্তীতে পদ্মা-যমুনা পাড়ি দিয়ে আসামে ডিব্রুগড়ে ৫১ দিনে নৌ ভ্রমণ শেষ করে। প্রায় ২শ ফুট লম্বা তিনতলা প্র্রমোদ তরীটি সুইজারল্যান্ড ও জার্মেনীর ২৮জন পর্যটক নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের ২৭টি নদী ও ৫০টি পর্যটন কেন্দ্র পরিদর্শন করে। বিশে^র দীর্ঘতম এ নৌ ভ্রমণে প্রতি পর্যটকের কাছ থেকে ৫১ দিনে ১২ লাখ ৫৯ হাজার ভারতীয় রুপি ভাড়া আদায় করা হয়েছে। যা ছিল বাংলাদেশী টাকায় ১৬ লাখ টাকারও বেশী। ১৮৭৪ সালে এ উপমহাদেশে বাষ্পীয় প্যাডেল হুইল জাহাজে যাত্রী পরিবহন শুরু করে বৃটিশ ‘আইজিএন’ এবং ‘আরএসএন কোম্পানী’। কিন্তু ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরে ’৪৮ সালে ভারত-বাংলাদেশ নৌযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে বৃটিশ-ভারতের ওই কোম্পনী দুটির কয়লা চালিত বাষ্পীয় প্যাডেল হুইল জাহাজের সাহায্যে কোলকাতা থেকে বরিশাল হয়ে নরায়নগঞ্জ পর্যন্ত যাত্রী ও পণ্য পরিবহন হতো। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের নৌযানও বরিশাল-কোলকাতা রুটে চলাচল করত। কিন্তু সুন্দরবনের গহীন বনে তাদের একটি নৌযান ডুবির প্রেক্ষিত তা বন্ধ হয়ে যায়। বৃটিশ ব্যক্তি মালিকানাধীন ‘ফ্লোটিলা নেভিগেশন’র নৌযানও এ নৌপথেই যাত্রী পরিবহন করতো দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত।
কিন্তু দেশ বিভাগের পরে এ সব সার্ভিসই বন্ধ হয়ে যায়। পরিবর্তীতে নারায়নগঞ্জ ও বরিশাল হয়ে রকেট স্টিমারের সাথে খুলনা থেকে কোলকাতাগামী ট্রেনের সংযোগ চালু ছিল ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ পর্যন্ত। নারায়নগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দমুখী স্টিমারের সাথে কোলকাতাগামী ট্রেনেরও সংযোগ সার্ভিস চালু ছিল ওই যুদ্ধপূর্ব সময় পর্যন্ত। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ভারত-বাংলাদেশ নৌ প্রটোকলের আওতায় কোলকাতা থেকে আংটিহারা-চালনা-মোংলা-বরিশাল হয়ে ভারতের আসামের ডিব্রুগর পর্যন্ত পণ্যবাহী নৌযান চলাচল অব্যাহত আছে।