4:05 pm , August 12, 2023
আরিফ আহমেদ, বিশেষ প্রতিবেদক ॥ বরিশালের বাজারে ইলিশ নেই। যা আছে তা মধ্যবিত্তের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর নি¤œবিত্ত বা হতদরিদ্র মানুষের মাছের বাজার থেকে দূরে থাকার গল্প আরো আগেই চালু হয়েছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সাথে পাল্লা দিয়ে কমেছে শ্রমজীবী মানুষের উপার্জন সক্ষমতা। এমন পরিস্থিতিতে ইলিশতো দূরের কথা মাছ-মাংসের দোকানেও যাওয়া বন্ধ অনেক পরিবারের। নগরীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ইলিশের এই আকাল চোখে পড়েছে শনিবার সকালেও। চৌমাথা, নতুনবাজার, বাংলা বাজারে তেমন একটা ইলিশ নেই। সাগরদি বাজারে একঝুড়িতে ১০/১২টি ইলিশ ছিলো কিন্তু দাম অনেক চড়া।
তাই রূপাতলী হাউজিং এর বাসিন্দা রোমানা ও শাহনাজ বেগম বড় আশা করে পোর্ট রোড বাজারে এসেছিলেন ইলিশের খোঁজে । রোমানার স্বামী আহমেদ আবার কোনো মাছই খেতে পছন্দ করেননা। তবে ইলিশ মাছ খুব মজা করে খান। যে কারণে ইলিশ কিনতে চান রোমানা। আর শাহনাজ বেগম এর একটি মাত্র ছেলে। সে ইলিশ খাওয়ার বায়না ধরেছে। কিন্তু পোর্ট রোড বাজারেও ইলিশের দাম অনেক চড়া। ১৫ বা ১২শ টাকার নীচে কোনো ইলিশ নেই। বাধ্য হয়েই ৮০০ টাকা দরে আধাকেজি জাটকা ইলিশ কিনলেন রোমানা। আর গৃহিণী শাহনাজ বেগম ১৫০০ টাকা দরের একটি ইলিশ নিয়ে মলিন মুখে বাড়ির পথ ধরলেন। আর কোনো পণ্য কেনার উপায় নেই তার।
বরিশালের ইলিশ মোকাম খ্যাত পোর্ট রোড বাজারে শনিবার সকালে হাতেগোনা ছয়-সাতজন মাছ বিক্রেতার ঝুড়িতে ইলিশ দেখা গেল। পাশে দাঁড়িয়ে ক্রেতার অবস্থা যাচাই করতে গিয়ে হতাশ হতে হলো। সকাল ১০টা থেকে বেলা ১২ টা পর্যন্ত মাত্র তিনটি ইলিশ বিক্রি হতে দেখা গেছে। তাও কিনেছেন সরকারি কর্মকর্তারা। টাকা এখন শুধু তাদের পকেটেই বলে মৃদু হাসি দিলেন বিক্রেতা আলী আকবর। বললেন, কোনো সাধারণ মানুষকে ইলিশ মাছের দামও জিজ্ঞেস করতে দেখা যায়নি সকাল থেকে এখন পর্যন্ত। শুধু ওই মহিলা দুজন আর এখন আপনি জিগাইলেন। মাছ বিক্রেতা আলী আকবর তার সামনের দুটি ঝুড়িতে রাখা মিডিয়াম ও ছোট ইলিশ দেখিয়ে আরো বললেন, সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে এই ইলিশ এখন। কেননা মাঝারিটা ১৬০০ টাকা, ছোটটি ১২৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। তার থেকে একটু দূরেই মাছ বিক্রেতা কালামের বড় আড়ৎ। সেখানে অন্যান্য মাছের পাশাপাশি কয়েকটি ঝুড়িতে বিভিন্ন সাইজের ইলিশ রাখা আছে। কালাম জানালেন, তার এখানে সর্বনি¤œ ১৫০০ টাকা ও সর্বোচ্চ ২৩৫০ টাকা কেজিতে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। ২৩৫০ টাকার ইলিশের সাইজ সোয়া দুই কেজি। আর ১৯০০ টাকার ইলিশটি দেড় কেজি ওজনের। ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ। আর জাটকা ইলিশ বিক্রি করছেন ৮০০ টাকা কেজিতে। দুটোর ওজন আধা কেজির একটু বেশি হবে হয়তো।
তিনি আরো বলেন, পোর্ট রোড বাজারে এবছর ইলিশের আমদানি খুবই কম। জেলেরা মাছ পায় না তাই খরচও পোষাতে পারেনা। যা একটু পাচ্ছে তা খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। তাই বাজারে ইলিশ মাছের দামও অনেক চড়া বলে জানান আবুল কালাম।
পোর্ট রোড বাজারের বড় আড়ৎদার মেসার্স মনু এন্ড ব্রাদার্স এর ব্যবসায়ী অঞ্জন দাস জানান, যেখানে একটি আড়তের সর্বনি¤œ চাহিদা ৫ মন ইলিশ সেখানে নিয়মিত একমন বা বেশি হলে দেড়মন মাছ পাচ্ছেন, এর বেশি পাচ্ছে না কেউ।
তিনি আরো বলেন, ইলিশ মাছের ধর্ম হচ্ছে উজান ঠেলা। স্রোতের বিপরীতে চলা। চলতি বছর পর্যাপ্ত উজান হচ্ছে তারপরও ইলিশের দেখা নেই নদীতে। সাগরে যাও কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে তা আর এদিকে আসেনি বরগুনা, পাথরঘাটা, গলাচিপা থেকেই রপ্তানি হয়ে গেছে ।
অঞ্জন আরো বলেন, এ বছর নিষেধাজ্ঞা চলাকালে প্রচুর ইলিশ পোনা ধরা হয়েছে এবং চাপালি মাছের নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। এই পোর্ট রোড বাজারেই কয়েক হাজার টন চাপালি নামে ইলিশের ছাও বেচাকেনা হয়েছে। যা প্রশাসন হয়তো বুঝতেই পারেনি। ওদিকে আমাদের নিষেধাজ্ঞা চলাকালে ভারতের জেলেদের মাছ ধরাটাও একটা বড় সমস্যা বলে দাবী করেন এই ব্যবসায়ী।
অঞ্জন দাস এর সাথে সহমত পোষণ করেন পাশের বড় আড়ৎদার মের্সার্স ইয়ার হোসেন সিকদারও। পোর্ট রোড বাজারের এই ব্যবসায়ীরা বললেন, গত জানুয়ারিতে তীব্র শীতেও এই মোকামে সর্বনি¤œ ৫৫০ মণ ইলিশ এসেছে। সেখানে চলতি বর্ষার ভরা মৌসুমে সবগুলো আড়ৎ মিলিয়ে ১০০ মন ইলিশ আসেনি। এটা ভয়ের কথা বলে জানান তারা।
তবে ইলিশ ধরা পড়বে এবং ভালো ও বড় জাতের ইলিশ পাবে বরিশালের জেলেরা বলে দাবী করেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ ) বিমল চন্দ দাস। তিনি বলেন, বরিশালের মোকামে ইলিশ কম সত্যি। কিন্তু যা আছে তার আকৃতি খুবই সুন্দর ও বড় জাতের। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জেলেরা সাগরে যেতে পারছেন না। তাই মাছ কিছুটা কম এই অঞ্চলে। পানি নামার যে ঢল তা ইলিশের জন্য উজান ঠেলার উপযোগী নয়। তবে মনপুরা, কক্সবাজার এলাকায় কিন্তু প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে বলে জানান তিনি।
বিমল চন্দ দাস আরো বলেন, চাপলি নামে ইলিশের বাচ্চা সব সময়ই কিছু না কিছু ধরা হয়েছে। ওটা চাপলি ধরা জালে ফেঁসে গেলে আর কিছু করার থাকেনা। তবে সেটা কারণ নয়, ইলিশ এখন বরিশালের মোকামে এমনিতেই কমই আসবে। কারণ, মোকামে মাছের নৌকা আসা কমে গেছে। অনেকস্থানেই সড়ক যোগাযোগ সহজ হয়েছে। পদ্মা ও পায়রা সেতুর সুফল এটাই। গলাচিপা, বামনা, পাথরঘাটা অঞ্চলের জেলেরা এখন আর বরিশাল নির্ভর নয়। তারা এখন সরাসরি কারওয়ান বাজার বা যাত্রাবাড়ী বাজারে ইলিশ নিয়ে যাচ্ছে কিংবা সহজে বড় আড়ৎদার ঘাটেই পেয়ে যাচ্ছে বলে জানান এই মৎস্য কর্মকর্তা।