বরিশালে কোচিং বাণিজ্যে দিশেহারা অভিভাবক : আতংকিত শিক্ষার্থীরা বরিশালে কোচিং বাণিজ্যে দিশেহারা অভিভাবক : আতংকিত শিক্ষার্থীরা - ajkerparibartan.com
বরিশালে কোচিং বাণিজ্যে দিশেহারা অভিভাবক : আতংকিত শিক্ষার্থীরা

3:43 pm , July 25, 2023

বিশেষ প্রতিবেদক ॥ সকালে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই কোচিং-এ যাওয়ার তাড়া। এরপর শ্রেণি কক্ষের ক্লাস শেষে আবারও কোচিং। মাঝে দুপুরের খাবারটা কোনোভাবে গলদকরণের পর কোচিং করে ঘরে ফিরতে সেই সন্ধ্যা। খেলাধুলা বা বিনোদন বলে কিছু নেই শিক্ষার্থীদের জীবনে।
এমনটা বরিশালের বেশিরভাগ স্কুল-কলেজ, এমনকি কিন্ডারগার্টেন পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের প্রতিদিনের রুটিন। পড়াশুনার এই বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় দিশেহারা অভিভাবকরা বলছেন, আর পারিনা। এতো টাকা খরচের পরও শিক্ষা কই? কারণ, সন্তানরা বেশিরভাগ রোবট হচ্ছে, মানবিক গুণাবলি কিছুই নেই তাদের ভিতর। আর শিক্ষার্থীদের বড় এজটি অংশের অভিযোগ, শিক্ষকরা চাইলেই যে পড়াটা ক্লাসেই বুঝিয়ে দিতে পারেন, সেটা তারা কোচিং এর জন্য তুলে রেখে আমাদের কোচিং করতে বাধ্য করছেন। প্রবীণ শিক্ষকদের দাবি, পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলা শিশুদের খাঁটি মানুষ হতে সাহায্য করে। আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি এজন্য ধর্মীয় শিক্ষাও জরুরী বলে মনে করেন বরিশাল শিক্ষক সমিতির সভাপতি ফরিদুল আলম জাহাঙ্গীর তালুকদার। তিনি বলেন, শিশুর প্রথম শিক্ষক বাবা-মা। তারপরই বিদ্যালয় বা শিশু নিকেতন এর শিক্ষকদের ভূমিকা। এখানে যদি কোচিং বাণিজ্য ঢুকে যায়, তাহলে এটা খুবই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে শিশুদের মনে। ফরিদুল আলম আরো বলেন,  শিশু শিক্ষা প্রদানের সময়ই তাকে আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষাও দিতে হবে। শিশুর জন্য পর্যাপ্ত খেলাধুলার ব্যবস্থাও রাখতে হবে বলে জানান তিনি। শিক্ষক নেতা ও আদর্শ শিক্ষক হিসেবে পরিচিত এসসিজিএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আশীষ দাস গুপ্ত বলেন, আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানতো সেটি, যেখানে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের মাধ্যমে শ্রেণি কক্ষেই পরিপূর্ণ করে তোলা হয়। জীবিকার প্রয়োজনে হয়তো কোচিং বা প্রাইভেট পড়ানো জরুরী হয়ে ওঠে। তবে তা কখনোই নৈতিকতা বিরুদ্ধ হলে চলবে না। এখনতো অবস্থা এমন হয়েছে যে এই বাণিজ্যিকরণের কারনে যথাযথ সম্মানটুকুও পাচ্ছেন না একজন শিক্ষক।
এদিকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, ধ্বংস হয়ে গেছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। স্কুল-কলেজ থেকে অবিলম্বে এসব কোচিং বাণিজ্য বন্ধের দাবি তাদের।
সরেজমিনে মঙ্গলবার বরিশাল নগরী ঘুরে অসংখ্য কোচিং সেন্টারের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। বরিশাল নগরী ছাড়িয়ে গ্রামের স্কুল কলেজেও পৌঁছে গেছে এই কোচিং সেন্টার। সাথে আছে স্কুল-কলেজের নিজস্ব কোচিং। বরিশালেতো এখন ঢাকার নামি-দামি কোচিং সেন্টারের সাইনবোর্ড ঝুলানোরও  প্রতিযোগিতা সব স্কুল কলেজের গেটে। বিএম কলেজের গেটেতো কলেজের সাইনবোর্ডটাই ঢাকা পরে গেছে কোচিং সেন্টারের দাপটে। অন্যদিকে বরিশাল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, জিলা স্কুল, উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, সরকারি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আরজুমনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, এআরএস বালিকা বিদ্যালয়, মানিক মিয়া স্কুল এন্ড কলেজসহ সব প্রতিষ্ঠানেই রীতিমত বানিজ্য চলছে।  কোচিং করতে বাধ্য করছেন ওই সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা।
এবিষয়ে বরিশালের সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এনায়েত হোসেন শিবলু ফেসবুক জুড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। তিনি বলেন, এই কোচিং বাণিজ্য শিক্ষার্থীদের মেধা ধ্বংস করে দিচ্ছে।  চলমান শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষনীয় উপকরণ খুবই কম দাবী করে শিবলু বলেন, আগে আমাদের সময় স্কুল কলেজ কম ছিলো এটা ঠিক। কিন্তু শিক্ষক ছিলেন। সত্যিকারের মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন তারা। আমাদের সময়ের প্রতিটি পাঠ্যবই ছিলো সামাজিক মূল্যবোধে পরিপূর্ণ। আজকের শিক্ষা যেমন, শিক্ষকও তেমনি।  এ অবস্থা চলতে থাকলে এ জাতির ধ্বংস হতে আর দেরি নেই বলে দাবী করেন এনায়েত হোসেন শিবলু।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকার ২০১২ সালে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা জারি করে। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন।
কিন্তু অভিভাবকদের একজন ও বরিশাল সাহিত্য সংসদের সভাপতি কাজী মিজানুর রহমান বলেন, এই নীতিমালার আরেক অংশে আবার সরকার নিজেই এটাকে বৈধ করে দিয়েছে। সেখানে বিভিন্ন উপধারাসহ মোট ১৪টি ধারা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকলে ও অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে স্কুলে ‘অতিরিক্ত ক্লাস’র ব্যবস্থা করা যাবে। এজন্য মেট্রোপলিটন ও বিভাগীয় এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রতি বিষয়ের জন্য গুনতে হবে ৩শ’ টাকা। জেলা শহরে ২৫০ টাকা এবং উপজেলা শহরে ১৫০ টাকা করে। এতে আরও বলা আছে, শিক্ষকরা নিজ বাসভবনে বা কোনো বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না। এমনকি তারা ক্লাসরুম বা অতিরিক্ত ক্লাসের বাইরে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। তবে অন্য প্রতিষ্ঠানের অনধিক দশজনকে কোচিং করাতে পারবেন। তবে শিক্ষকরা কোচিং এ  উৎসাহিত করতে পারবেন না। এমনকি শিক্ষকের নামে কোচিং সেন্টারের প্রচারণাও করা যাবে না। নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং করালে তার এমপিও বাতিলসহ অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথাও সেখানে উল্লেখ আছে বলে জানান কাজী মিজানুর রহমান।
বরিশাল জিলা স্কুলের সামনে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়–য়া সন্তানের জন্য অপেক্ষারত একজন অভিভাবক জানান, স্কুল টাইম সকাল সাতটা থেকে সোয়া এগারোটা। বারটা থেকে কোচিং দুটো পর্যন্ত। ছয় সাবজেক্টে ১২০০ টাকা কোচিং ফি দিতে হয়। বরিশাল জিলা স্কুলে ১০টা থেকে এই কোচিং শুরু হয় বলে জানান তিনি।
জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক নুরুল ইসলাম বলেন, আমরা সরকারের নিয়ম মেনেই অতিরিক্ত সময়ে ক্লাস করাচ্ছি। এটা বৈধ। এটা কোচিং নয়। তিনি আরো বলেন, আমিতো মনে করি স্কুলে সঠিক ক্লাস হলে এবং বাবা-মা একটু সচেতন হলে কোনো কোচিং এর প্রয়োজন হয়না।
অভিভাবকদের অনেকেরই অভিযোগ, সরকারের ওই নীতিমালার পর কোচিং বাণিজ্য আরও উৎসাহিত হয়েছে। বিশেষ করে বরিশালের বিভিন্ন স্কুলে জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার আগে বাধ্যতামূলক কোচিং এর আয়োজন হচ্ছে সবসময়। পরীক্ষার আগে স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ বাধ্যতামূলক অতিরিক্ত ক্লাসের নামে কোচিং এর ব্যবস্থা করেন বলে জানান অভিভাবকরা। প্রতিবছর পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণের সময়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আলাদাভাবে নগদে কোচিং ফি গ্রহণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করবেন বলে জানান  বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) মনদীপ ঘরাই। তিনি বলেন, বেশকিছু স্কুল সম্পর্কে এমন অভিযোগ কানে এসেছে। তবে তা প্রমাণিত নয়। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে অভিযান চালাবো। প্রমান পাওয়া গেলে  এমপিও বাতিলের সুপারিশ করা হবে।
এ ব্যাপারে জেলা শিক্ষা অফিসার জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সরকারের নীতিমালার বাইরে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠিন ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমপিও বাতিল করে দেয়ারও নির্দেশনা ওই আইনেই রয়েছে বলে জানান তিনি।
জাহাঙ্গীর হোসেন আরো বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন আর কোচিং হয়না। যদি বাধ্যতামূলক কোথাও অতিরিক্ত ক্লাসের নামে কোচিং করানো হয় তা পরিহার করতে ও এবিষয়ে প্রশাসনকে অবহিত করতে বাবা-মাকে সতর্ক হবার পরামর্শ দেন তিনি।

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন    
সম্পাদক ও প্রকাশক: কাজী মিরাজ মাহমুদ
 
বার্তা ও বানিজ্যিক কার্যালয়ঃ কুশলা হাউজ, ১৩৮ বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়ক,
সদর রোড (শহীদ মিনারের বিপরীতে), বরিশাল-৮২০০।
© প্রকাশক কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by NEXTZEN-IT